আজ থেকে প্রায় ২,০০০ বছর আগে রোমানরা সর্বপ্রথম নল “পাইপ” আবিষ্কার করেছিলো। তারা নল আবিষ্কার করে, এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পানি নিয়ে যাওয়ার অভিনব পরিবর্তন এনেছিল। কিন্তু ভেবে দেখুন এমন নলের কথা, যা পানি নয়—বরং আপনার ইন্টারনেট ডাটা, ইমেইল আর ফোন কল এক স্থান থেকে আরেক স্থানে বয়ে নিয়ে যায়। এই নলের মধ্যে আলোর মাধ্যমে ডিজিটাল ডাটা প্রবাহ করিয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। হ্যাঁ বন্ধুরা, আমি ফাইবার অপটিক বা অপটিক্যাল ফাইবার এর কথা বলছি। তো চলুন জেনে নেওয়া যাক, কীভাবে এই পাইপ সেকেন্ডের মধ্যে সকল ডাটা পরিবহন করে নিয়ে যায়।
তথ্য যে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রবাহিত হতে পারে এই ধারণাকে কাজে লাগিয়েই আমরা অনেক প্রকারের কাজ করে থাকি। যখন আমরা টেলিফোনে কথা বলি তখন আমাদের কণ্ঠস্বর থেকে শব্দ তারের মাধ্যমে আমাদের ঘরের দেওয়ালের সকেটের মধ্যদিয়ে তা আরেকজনের টেলিফনের তারের সাথে যুক্ত হয় এবং লোকাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে কথাবার্তা সম্পূর্ণ হয়ে থাকে। সেলফোন কিন্তু আবার সম্পূর্ণ আলাদা পদ্ধতিতে কাজ করেঃ এরা তথ্য আদান প্রদান করার জন্য এক অদৃশ্য রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে—আর এই প্রযুক্তিকে ওয়্যারলেস প্রযুক্তি বলে, কেনোনা এতে কোন তার থাকে না। ফাইবার অপটিক বা অপটিক্যাল ফাইবার আরেক পদ্ধতিতে কাজ করে। এটি কোন তথ্যকে কোডে পরিণত করে আলোর মাধ্যমে একটি কাঁচের বা প্ল্যাস্টিকের পাইপের মধ্যদিয়ে ছুড়ে মারা হয়। এটি সর্বপ্রথম এন্ডস্কোপ উন্নতিকরন করার সময় কাজে নেওয়া হয়েছিলো। এন্ডস্কোপ হলো একটি মেডিক্যাল যন্ত্র, যা ডাক্তারদের মানবদেহ না কেটেই এর ভেতরে সবকিছু দেখতে সাহায্য করে। ১৯৬০ সালের দিকে ইঞ্জিনিয়াররা এই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে টেলিফোন কল ট্র্যান্সমিট করে আলোর সাহায্যে। আলোর গতি সাধারনত ১৮৬,০০০ মাইল বা ৩০০,০০০ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড হয়ে থাকে কিন্তু ফাইবার অপটিক ক্যাবলে তা তিন ভাগের দুইভাগ হয়ে থাকে।
ফাইবার অপটিক বা অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল অত্যন্ত পাতলা কাঁচ বা প্ল্যাস্টিকের সমন্বয়ে তৈরি হয়ে থাকে যা অপটিক্যাল ফাইবার নামে পরিচিত। একটি ক্যাবলের মধ্যে মানুষের মাথার চুলের চেয়েও দশগুন বেশি পাতলা তন্তু থাকে, এই তন্তুর পরিমান কয়েকটি থেকে কয়েকশত পর্যন্ত হতে পারে। এক একটি তন্তু একসাথে ২৫,০০০ টেলিফোন কল বহন করতে সক্ষম এবং একটি সম্পূর্ণ ক্যাবল একসাথে কয়েক মিলিয়ন কল বহন করতে পারে।
ফাইবার অপটিক ক্যাবল সম্পূর্ণভাবে অপটিক্যাল (আলোর উপর নির্ভর) প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুইটি জায়গার মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করাতে পারে। মনে করুন আপনি আপনার কম্পিউটার হতে কোন তথ্য আপনার বন্ধুর কম্পিউটারে ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মাধ্যমে পাঠাতে চান, মনে করুন আপনার বন্ধুর বাসা রাস্তার ঐপারে। তাহলে এখন আপনার কম্পিউটারটিকে একটি লেজারের সাথে সম্পর্কযুক্ত করাতে হবে, যা কম্পিউটারের ইলেকট্রিকাল তথ্য গুলোকে একটি ক্রমিক লাইট পালসে পরিণত করবে। এবার আপনাকে সেই লেজারবীমটি ফাইবার অপটিক ক্যাবলে ফেলাতে হবে। আপনার ছুড়ে মারা লাইট বীমটি ক্যাবলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গিয়ে পৌঁছাবে, মানে আপনার বন্ধুর কাছে গিয়ে পৌঁছাবে। এখন আপনার বন্ধুর একটি ফটোইলেক্ট্রনিক সেলের (আলো সনাক্ত করার কম্পোনেন্ট) প্রয়োজন পড়বে, যা লাইট পালসকে আবার ইলেকট্রিকাল তথ্যে পরিণত করবে যাতে কম্পিউটার তা বুঝতে পারে। আর এই হলো অপটিক্যাল প্রযুক্তির মূল মন্ত্র।
আমরা স্কুলে পড়েছি যে, আলো সর্বদা সমান্তরাল পথে চলে। কিন্তু এখানে আলো কীভাবে কোন আঁকাবাঁকা নলের মধ্যদিয়ে চলতে পারে? খুব ভালো প্রশ্ন, চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক। ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মধ্যদিয়ে আলো চলার সময় তা বারবার ভেতরে ক্যাবলের গায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে গমন করে। প্রত্যেকটি ফোটন (আলোর কণা) ক্যাবলের দেওয়ালে লাফিয়ে লাফিয়ে পথ অতিক্রম করে। আপনি হয়তো ভাবছেন যে, আলো যদি কোন গ্লাসের সাথে ধাক্কা খায় তবে ধাক্কা খাওয়া স্থলে আলো আটকে যাবে। কিন্তু আলো যদি কোন অগভীর কোণে (৪২ ডিগ্রিরও কম) কোন গ্লাসের সাথে ধাক্কা খায় তবে তা প্রতিফলিত হয়ে আরেক পথে চলতে আরম্ভ করে। যেমনটা কোন আয়নাতে টর্চলাইট মারলে সেই আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে আবার আপনার কাছেই ফিরে আসে এবং টর্চ মারার কোন নিয়ন্ত্রন করার মাধ্যমে আপনি প্রতিফলিত আলোকরশ্মির দিকও নিয়ন্ত্রন করতে পারেন। যাই হোক, এই সম্পূর্ণ বিষয়টিকে বিজ্ঞানের ভাষায় টোটাল ইন্টারনাল রিফ্লেক্সন (total internal reflection) বলা হয়। আর এই ধর্মের ফলেই আলো বারবার প্রতিফলিত হয়ে পাইপের মধ্যেই থাকে।
তবে আরেকটি ব্যাপার রয়েছে, যা আলোকে ক্যাবলের মধ্যে রাখতে সাহায্য করে থাকে, আর তা হলো ক্যাবলের গঠন। ক্যাবলটি দুটি ভিন্ন অংশ দ্বারা প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। একটি হলো ক্যাবলটির মধ্যস্থল, যার ভেতর দিয়ে আলো গমন করে—একে কোর বলা হয়। আবার এই কোরের বাহিরদিক দিয়ে জড়ানো আরেকটি কাঁচের আস্তরণ থাকে যাকে ক্ল্যাডিং (cladding) বলা হয়। ক্ল্যাডিং এর কাজ হলো আলোক সিগন্যালকে কোরের ভেতরে ধরে রাখা। ক্ল্যাডিং তার কাজ খুব ভাল করেই করতে পারে, কেনোনা এটি এক আলাদা গ্লাসের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়।
কোন গ্লাস বা প্ল্যাস্টিকের তৈরি নলের মধ্য দিয়ে আলো গমন করে নিয়ে যাওয়া হয়তো বিজ্ঞানের কোন জাদুর ট্রিক মনে হতে পারে। আপনি হয়তো ভাবতেই পারবেন না যে এই ট্রিকের উপরে কোন ব্যস্তব জীবনের অ্যাপ্লিকেশন থাকতে পারে। কিন্তু যেভাবে ইলেক্ট্রিসিটি বিভিন্ন মেশিনকে পাওয়ার জোগাতে পারে ঠিক তেমনি আলোকরশ্মি তথ্য বহন করতে পারে—আর এই জন্যই আমরা একে বিভিন্ন কাজে ব্যবহারও করতে পারি। এই প্রযুক্তি বর্তমানে কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং, ব্রডকাস্টিং, মেডিক্যাল স্ক্যানিং, এবং মিলিটারি উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ফাইবার অপটিক ক্যাবলকে বর্তমানে প্রধানত লম্বা দুরত্বের মধ্যে তথ্য বহন করার কাজে ব্যবহার করা হয়—কেনোনা এটির পুরাতন স্টাইলের কপার ক্যাবল হতে ৩টি বড় বড় সুবিধা রয়েছে।
আপনি এই তথ্য গুলো এই ব্লগ থেকে পড়তে পারছেন বলে আপনার ইন্টারনেটকে ধন্যবাদ দেওয়া প্রয়োজন। শুধু এই ব্লগটির সার্ভার নয়, বরং আপনার পছন্দের সার্চ ইঞ্জিন গুগলও গোটা পৃথিবী ব্যাপী বহুত বড় বড় ইন্টারনেট ডাটা সেন্টার গুলোকে ফাইবার-অপটিক ক্যাবলের মাধ্যমে কানেক্টেড রেখেছে। এমনকি হয়তো আপনিও ফাইবার-অপটিক ব্রডব্যান্ড ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন, হয়তোবা এই মুহূর্তে টেকহাবস পড়ছেন। আপনি জানেন কি, এক হিসাব থেকে জানা গেছে, গোটা পৃথিবীর প্রায় ৯৯% ইন্টারনেট অপটিক ক্যাবল দ্বারা প্রবাহিত হচ্ছে।
আমরা যতো দ্রুততর ইন্টারনেট সেবা পাবো—তোতোই অনেক বেশি আডভান্স কাজকর্ম করতে পারবো, যেমন ক্লাউড কম্পিউটিং। বেশি গতির ইন্টারনেট মানে অনলাইন এইচডি ভিডিও স্টিম, অনলাইন টিভি দেখা, অথবা বড় বড় ফাইল ডাউনলোড করা। তাছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মে ইন্টারনেট অফ থিংগস চালানোর জন্য অবশ্যই প্রয়োজন পড়বে দ্রুততর ইন্টারনেট সেবার, আর অপটিক্যাল ফাইবারই পারে তা পূরণ করতে।
২০ শতকের শুরুর দিকে রেডিও এবং টিভির ব্রডকাস্টিং ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভস ব্যবহার করে করা হতো। যেখানে একটি সিগন্যাল ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে বাতাসে সিগন্যাল ছুড়ে মারা হতো এবং আমাদের বাড়িতে থাকা শতশত অ্যান্টেনা সেই সিগন্যাল গুলোকে ধরে ফেলত। আজকের দিনেও আমরা রেডিওতে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভস ব্যবহার করি, শুধু টিভি ব্রডকাস্টিং করার জন্য অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করি।
ক্যাবল টিভি কোম্পানি প্রথমে কোয়াক্সিয়াল ক্যাবল (coaxial cable) (একটি কপারের ক্যাবল, যাতে ধাতব বস্তু চারপাশে পেঁচানো থাকে, যাতে সিগন্যাল ব্যতিচার না ঘটে) ব্যবহার করে টিভি ব্রডকাস্টিং চালাত। আর এতে অ্যানালগ টিভি সিগন্যাল পাঠানো হতো। কিন্তু টিভি প্রযুক্তি যখন অ্যানালগ থেকে ডিজিটালে চলে আসলো তখন টিভি কোম্পানিরা অপটিক ক্যাবল ব্যবহার করার প্রয়োজন বোধ করতে আরম্ভ করলো।
ফাইবার অপটিক ক্যাবলে সিগন্যাল ব্যতিচার অনেক কম বলে, এটি অত্যন্ত ভালো পিকচার এবং সাউন্ড কোয়ালিটি প্রদান করতে পারে। আর তাছাড়া অনেক কম অ্যামপ্লিফাইং করেই সিগন্যাল অনেক দূর পর্যন্ত পাঠানো সম্ভব। তাছাড়া আজকের আইপি টিভি (ইন্টারনেট প্রোটোকল টিভি) গুলো অপটিক ক্যাবল ব্যবহার করে প্যাকেট সুইচিং এর মাধ্যমে অত্যন্ত ভালো পিকচার এবং সাউন্ড প্রদান করে। আইপি টিভি নিয়ে সামনে একটি টিউন লিখে ফেলবো ইনশাআল্লাহ্।
বহুত আগে থেকে মেডিক্যাল গ্যাজেটে ফাইবার অপটিক ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যার মাধ্যমে ডাক্তারেরা মানবদেহে কোন প্রকারের কাঁটাছেঁড়া না করেই দেহের অভ্যন্তরে দেখতে সক্ষম হতো। তাছাড়া এই অপটিক্যাল ক্যাবল চিকন, লাইটওয়েট, হাই-ক্যাপাসিটি, এবং অত্যন্ত নিরাপদ হওয়ার জন্য মিলিটারিরা একে বিভিন্ন কাজে যেমন রাডার, মিশাইল, ইত্যাদিতে ব্যবহার করে থাকেন। তাছাড়া তাদের গোপন সার্ভার গুলোও এই ক্যাবলের মাধ্যমে কানেক্ট করা থাকে। আর তাছাড়া কপার ক্যাবলের চেয়ে অপটিক্যাল ক্যাবল দামে অনেক বেশি সস্তা হয়ে থাকে।
আশা করছি ফাইবার অপটিক বা অপটিক্যাল ফাইবার সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানলেন। জানলেন, কীভাবে আলোর মাধ্যমে কম্পিউটার ডাটা বহন করা সম্ভব। আমি সামনের দিনে রাডার এবং আইপি টিভি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। আজকের টিউনটি কেমন লেগেছে বা আপনার যেকোনো প্রশ্ন নিচে টিউমেন্ট করে আমাকে জানাতে ভুলবেন না। সাথে টিউনটি শেয়ার করে এই ব্লগকে সমর্থন করুন।
পূর্বে প্রকাশিত- টেকহাবস.নেট
আমি তাহমিদ বোরহান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 10 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 177 টি টিউন ও 680 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 43 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।
আমি তাহমিদ বোরহান। টেক নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকতে ভালোবাসি। টেকটিউন্স সহ নিজের কিছু টেক ব্লগ লিখি। TecHubs ব্লগ এবং TecHubs TV ইউটিউব চ্যানেল হলো আমার প্যাশন, তাই এখানে কিছু অসাধারণ করারই চেষ্টা করি!
প্রিয়তে রাখছি 🙂