বন্ধুরা সবাই কেমন আছেন? আশা করছি আপনারা সকলেই আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। বন্ধুরা আজকের এই টিউনটি আমার অন্যান্য টিউন এর চাইতে ব্যতিক্রম হতে চলেছে। তো বন্ধুরা, আমরা হয়তোবা অনেকেই ছোটবেলায় ভেবে থাকতে পারি যে যদি আমি দেশের সরকার হতাম তবে কোটি কোটি টাকা ছাপাতাম নিজের জন্য। কেন আমাকে এত টাকার জন্য কষ্ট করতে হবে, ইচ্ছে করলেই কী টাকা বানানো যায়না?
হ্যাঁ বন্ধুরা, ইচ্ছা করলেই কোন দেশের সরকার নিজের দেশের জন্য অগণিত টাকা তৈরি করতে পারে। তবে কোন দেশের সরকার সেই দেশের জন্য অগণিত টাকা তৈরি করে না। একটি দেশের সরকার কেন দেশের জন্য অতিরিক্ত টাকা তৈরি করে না এবং তৈরি করলে কি ক্ষতি হয় সেসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব আজকের এই টিউনে। এজন্য অবশ্যই সম্পূর্ণ টিউনটি মনোযোগ দিয়ে দেখার অনুরোধ করছি। এজন্য আপনাদেরকে যা করতে হবে তা হলো, আজকের টিউনটি সম্পূর্ণ দেখা।
ছোটবেলায় তো আমরা আমাদের বাবা-মার কাছে টাকার বেশি আবদার করলে তারা বলতো আমার কি টাকার গাছ রয়েছে যে সেখান থেকে পেরে দেব? সে সময় আমাদের মাথায় চলে আসতে যে, সত্যিই যদি টাকার গাছ থাকতো কিংবা আমাদের কাছে টাকা বানানোর মেশিন থাকতো তবে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা বানিয়ে নিতে পারতাম। তখন সব কাজ ফেলে শুধু টাকাই বানাতাম, টাকার জন্য এত হাহাকার কেন হবে। ক্ষমতা থাকার পরেও কেন সরকার টাকা ছাপায় না, আর এরকম সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা সরকারকে বোকা বলতেও ভুল করতাম না। যে প্রশ্নটি আমাদের মাথায় চলে আসা স্বভাবেই বটে।
আচ্ছা এখন আপনার মাথায় কি চলে আসছে না যে, সরকার কেন অতিরিক্ত টাকা বানিয়ে মানুষের হাতে হাতে দিচ্ছে না? দেশের অর্থনীতিকে আরো সচল করছে না বা দেশের বড় বড় মেগা প্রজেক্ট গুলোর অর্থ নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছে না? আমাদের মতে সরকার যদি বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা ছাপিয়ে আমাদের হাতে তুলে দেয় তবেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। অথবা সরকার যদি বস্তা বস্তা টাকা তৈরি করে পদ্মা সেতু, মেঘনা সেতু নির্মাণ করে তাহলেই বা সমস্যা কোথায়? এর উত্তর হবে অনেক বড় সমস্যা।
সরকার যদি বেশি বেশি পরিমাণ টাকা ছাপায় তবে যে, এত বড় সমস্যা হবে তা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। যেটির কোন সহজ সমাধান হলে তো আর কোনো চিন্তাই থাকতো না। দেশের উন্নয়ন করার জন্য যদি কোন দেশের সরকার যদি বস্তা বস্তা মুদ্রা বা টাকা তৈরি করে তবে সেটি হবে সেই দেশের জন্য অনেক বড় সমস্যার কারণ। কোন দেশের টাকা তৈরি করার দায়িত্ব থাকে সেই দেশের একমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। একমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পারে দেশের জন্য টাকা তৈরি করতে পারতে। তো এবার এখানে প্রশ্ন আসে যে কিসের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা তৈরি করে?
কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেই মন চাইলে যত ইচ্ছা টাকা তৈরি করতে পারে। কিন্তু তারা সেটি করে না, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইচ্ছা করে যত ইচ্ছা টাকা তৈরি করে না। কোন দেশের টাকা প্রিন্ট করার ক্ষেত্রে কারও হস্তক্ষেপ নেই, এখানে কোন দেশের সরকার যত ইচ্ছা টাকা প্রিন্ট করতে পারে। তবে পৃথিবীর কোন দেশেই যত ইচ্ছা টাকা তৈরি করে না। টাকা তৈরি করা হয় কোন দেশের অর্থনীতির ভারসাম্য রেখে এবং তার সঙ্গে মিল রেখে।
টাকা উৎপাদন এর সঙ্গে জড়িত কোন দেশের মানুষের উপার্জন, অর্থনৈতিক চাহিদা, দেশের সম্পদ ইত্যাদি। এর বেশি টাকা উৎপাদন করলেই তৈরি হয় সমস্যা। চাহিদার তুলনায় বেশি টাকা তৈরি করলেন দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য হারাতে থাকে। যে কারণে কোন দেশের সরকার চাইলে কিংবা ইচ্ছা করে যত ইচ্ছা টাকা তৈরি করে না। এ বিষয়টিকে আপনাকে বোঝানোর জন্য একটি ঘটনা বলা যাক।
এটি ১৯২০ সালের ঘটনা, সে সময় খুব সম্ভবত জার্মানির সরকার খুব বেশি পরিমাণে টাকা ছাপিয়ে বড়লোক হবার চিন্তা করেছিল। কিন্তু তা আদৌ সম্ভব না। মাত্রার চাইতে বেশি পরিমাণ টাকা ছাপালে তা হিতে বিপরীত হয়। জার্মানিতে অতিরিক্ত টাকা ছাপানোয় ১৯২০ সালে মুদ্রাস্ফীতির কারণে সেখানকার মানুষকে ঠেলাগাড়িতে করে টাকা নিয়ে বাজার করতে হতো। এমনও শোনা যায় যে, মানুষ তাদের টাকাকে রেখে ঠেলা গাড়ি চুরি করা শুরু করেছিল। ইতিহাস ঘাঁটলে এরকম ঘটনা আরো পাওয়া যাবে।
এরকমই একটি ঘটনা ঘটেছিল ভেনেজুয়েলার ক্ষেত্রে। মানুষের কাছে দ্রব্যের চাইতে অর্থ অনেক বেশি হয়ে যাবার কারণে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য দাম কমিয়ে দিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে এসব দ্রব্য বাজার থেকে খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যায়, কেননা সেই সময় মানুষের হাতে অতিরিক্ত অর্থ ছিল সেগুলো কেনার জন্য এবং সেগুলো মানুষ দ্রুত কিনে নিয়েছিল। ঠিক একই রকমভাবে জিম্বাবুয়ের অর্থনীতিতে ও ধস নেমেছিল।
জিম্বাবুয়ের অর্থনীতিতে ধস নামার ঘটনাটি খুব আগের নয়, এটি ২০০৮ সালের কথা। মুদ্রাস্ফীতির কারণ এর সেসময়ে আজকের ১০০ টাকার পণ্যের দাম আগামীকাল ১৮০ টাকা হয়ে যেত। শোনা যায় সে সময় এক থলে ভর্তি টাকা নিয়ে গিয়ে একটিমাত্র চকলেট কিনে নিয়ে আসতে হতো। এসব সমস্যার কারণ কি?
তো দেখুন, আমরা যে এতদিন জেনে এসেছি টাকার মূল্য রয়েছে। কিন্তু আপনি কি এটা কখনো ভেবেছেন যে টাকার কোন মূল্য নেই। টাকা শুধুমাত্র একটি কাগজে নোট মাত্র যেটা বিনিময় হয়। কোন কিছুর মূল্য বলতে কোন একটি সম্পদের মূল্য বুঝায়, এখানে টাকা দিয়ে ঐ সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। যেখানে টাকার কোন মূল্য নেই, বরং মূল্য হচ্ছে সেই পণ্য বা সম্পদটির।
এবার আপনি যদি কোন একটি দ্রব্য কিনতে চান তবে সেই দ্রব্যের মূল্য অনুযায়ী আপনাকে সেই পরিমাণ টাকা দিতে হবে। এখানে যে কোন পরিমাণ টাকার নোট হচ্ছে একটি অংক মাত্র। যেই পরিমান নোটটি দিয়ে পণ্যটি নেওয়া হয় কেনা হয়। এখানে আমরা জানতে পারলাম যে, টাকার কোন মূল্য নেই বরং মূল্য হয়েছে সেই সম্পদের। তো চলুন, এজন্য আপনাকে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
উদাহরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যাক, একটি দেশের সম্পদ বলতে রয়েছে ৫টি কলম। এবার সেই কলম গুলোর বিক্রয় মূল্য যদি দুই টাকা করে হয় তবে সেই দেশ বছরে ১০ টাকা প্রিন্ট করে। উৎপাদন খরচ, খুচরা মূল্য, পাইকারি মূল্য ইত্যাদি জটিলতা বাদ দিয়ে প্রতিটি কলমের মূল্য দুই টাকা। তাহলে সেই দেশের মোট সম্পদ এবং মোট টাকার পরিমান সমান হয়ে গেল। এখানে এই দেশের সম্পদ এবং দেশের ভেতরে থাকা অর্থের পরিমাণ একটি ভারসাম্য অবস্থায় থাকলো, যেখানে সেই দেশের মানুষ যদি কলম কিনতে চায় তবে সেই টাকা দিয়ে সেই পাঁচটি কলম ই কিনতে পারবে।
এবার পরবর্তী বছরে যদি সেই দেশ আবার অতিরিক্ত টাকা ছাপায়, অর্থাৎ সেদেশ যদি পরবর্তী বছরে আরো ১০ টাকা প্রিন্ট করে তবে তাহলে সেই দেশের টাকা হল ২০ টাকা। কিন্তু সে সময় ও সেই দেশের মোট সম্পদ বা সেদেশের কলম এর সংখ্যা ৫টিই ছিল। যেহেতু সে সময়ে দেশে নতুন কোনো সম্পদ আর নেই, সেজন্য সেই পাঁচটি কলমের মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গিয়ে সেগুলোর প্রত্যেকটির দাম পড়বে চার টাকা। যেটি প্রথম বছরে ছিল প্রত্যেকটি কলমের মূল্য দুই টাকা করে।
এখানে পরবর্তী বছরে সম্পদের পরিমাণ না বাড়ার কারণে কলমের মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেল, কেননা সম্পদ এর তুলনায় পরবর্তী বছরে আরো ১০ টাকা অতিরিক্ত ছাপানো হয়েছে। তবে যদি পরবর্তী বছরে এই দশটাকা অতিরিক্ত না ছাপানো যেত তবে কলম গুলোর মূল্য দুই টাকা করেই হত। দেশের ভেতরে সেই দুই টাকা দিয়ে আবার অন্য কেউ সেগুলো কিনে দিতে পারতো এবং এক্ষেত্রে সম্পদ এবং দেশের ভেতরে টাকার পরিমানের সমতা থাকতো। যেহেতু এখানে পরবর্তী বছরে আবার অতিরিক্ত ১০ টাকা ছাপানো হয়েছে সেজন্য সেই কলম গুলো আবার অতিরিক্ত দ্বিগুণ টাকা দিয়ে কিনে নিতে হবে, কেননা সেই সময় মানুষের কাছে টাকার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে।
এভাবেই দেশের মোট সম্পদ এর তুলনায় অতিরিক্ত টাকা উৎপাদন করলে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যায়। যেহেতু বেশি পরিমাণ টাকা ছাপা হলে সে দেশের মানুষের কাছে বেশি পরিমাণে টাকা থাকবে, সে ক্ষেত্রে সবাই সেই পণ্যটি বেশি দামে হলেও কিনতে চাইবে। এক্ষেত্রে টাকার দাম বা ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়, আর একেই বলে মুদ্রাস্ফীতি। এই উদাহরণ যদি আপনি না বুঝে থাকেন তবে আপনাকে আরো ভালোভাবে বোঝানো যাক। চলুন তবে আরো একবার এই বিষয়টিকে ভালোভাবে জেনে নেওয়া যাক।
মনে করুন, কোন দেশের মোট সম্পদ বলতে দশটি মোবাইল ফোন এবং সেই দেশ বছরে একহাজার টাকা তৈরি করে। এক্ষেত্রে সেই দেশের প্রত্যেকটি মোবাইল ফোন এর দাম পড়বে ১০০ টাকা করে এবং এভাবে করে সবগুলো মোবাইলের দাম হয় ১ হাজার টাকা। যেহেতু সেই দেশের মোট সম্পদ বলতে সেই দশটি মোবাইল রয়েছে, আর এজন্য সেই দেশের মোট টাকার পরিমান হওয়া দরকার ১০০০ টাকা। যদি দেশটির মোট টাকার পরিমান ১০০০ হয় তবে টাকার বিপরীতে সম্পদের পরিমাণ সমান হবে, অর্থাৎ টাকা এবং সম্পদের পরিমাণ ভারসাম্য অবস্থায় থাকবে। এবার সেই দেশে যদি পরবর্তী বছরে আবার নতুন টাকা তৈরি করে তবে কি হবে?
সেই দেশটির যদি পরবর্তী বছরে আবার নতুন কোন টাকা তৈরি করে তবে সে ক্ষেত্রে সেই মোবাইলের দাম বেড়ে যাবে। কেননা পরবর্তী বছরে সেই দেশের সম্পদ বলতে রয়েছে সেই দশটি মোবাইল। এবার সেই দেশ যদি পরবর্তী বছরে আরো ১০০০ টাকা তৈরি করে তবে টাকার বিপরীতে সেই মোবাইলের দাম হবে প্রত্যেকটির ২০০ টাকা করে। অর্থাৎ এখানে সেই দেশের মোট টাকার বিপরীতে সম্পদ এর মূল্য ভাগ হয়ে যাবে। এখানে প্রত্যেকটি দ্রব্যমূল্যের দাম হয়ে গেলো দ্বিগুণ।
যদি সরকারের বেশি বেশি টাকা ছাপানোর ফলে দেশের ভেতরে সকল দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যায় তবে বেশি বেশি টাকা ছাপিয়ে কি হলো? তাই দেশের সম্পদ অনুযায়ী টাকা ছাপানোর জন্য একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রীতিমতো গবেষণা করে টাকা তৈরি করা হয়। সেক্ষেত্রে দেশের ভেতরে থাকা মোট সম্পদ বা সেবার পরিমাণ নির্ধারণ করে করতে হয় এবং সে অনুযায়ী টাকা তৈরি করতে হয়। সাধারণত একটি দেশের দুই থেকে ৩ শতাংশ পরিমাণ টাকা তৈরি করা হয়। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই পরিমাণ আরও একটু বেশি হতে পারে।
এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে কেন সরকার ইচ্ছামত টাকা তৈরি করতে পারে না। কোন দেশের সরকার যদি সে দেশে বেশি পরিমাণে টাকা তৈরি করে এবং সেটি যদি সেই দেশের সম্পদের পরিমাণের চাইতে বেশি হয় তবেই বিপদ। কোন দেশের সম্পদ এর চাইতে অতিরিক্ত পরিমাণে টাকা তৈরি হলে মানুষের কাছে বেশি পরিমাণে টাকা থাকবে। আর যদি মানুষের কাছে বেশি পরিমাণে টাকা থাকে তবে সে সেই টাকা দিয়ে বেশি পরিমাণে জিনিস কিনতে চাইবে। এভাবে করে সবাই যদি বেশি পরিমাণে দ্রব্য কেনে তবে বাজার ফাঁকা হয়ে যাবে।
এখানেই মূলত সমস্যার কারণ। যদি মানুষের কাছে বেশি পরিমাণে টাকা থাকে এবং বেশি পরিমাণে যদি দ্রব্যমূল্য কিনতে চায় তবে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাবে। ফলশ্রুতিতে দেখা দেবে মুদ্রাস্ফীতি। আজকে যে জিনিসের দাম ১০ টাকা, সেটি পরবর্তীতে দিনে সেটি হয়তোবা হয়ে যাবে ২০ টাকা। তাহলে বেশি টাকা মানুষের কাছে থেকে লাভ কি? যদি মানুষের কাছে সম্পদই না থাকে তবে এই অতিরিক্ত টাকা মানুষের কোন কাজেই আসবে না।
কেননা সেই অতিরিক্ত টাকায় সে বেশি পরিমাণে কোন কিছু কিনতে পারবেনা এবং সেগুলো কোন কাজে ব্যবহারও হবে না। যেখানে অতিরিক্ত এই টাকার কারণে দেশের প্রত্যেকটি দ্রব্য এর দাম বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে সেই অতিরিক্ত টাকাগুলো দিয়ে আবার পূর্বের বছরের মতোই জিনিসপত্র তারা কিনতে পারবে। কেননা পরবর্তী বছরের টাকা ছাপানো হলেও দেশের সম্পদের পরিমান বাড়েনি। এজন্য বেশি টাকা হয়ে যাবার কারণে সেই দ্রব্যমূল্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
এভাবে করে বেশি টাকা ছাপানোর ফলে দেশের অর্থনীতির চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন উদাহরণ আপনারা জিম্বাবুয়ে কিংবা ভেনেজুয়েলা এর মত দেশের ক্ষেত্রে দেখতে পেরেছেন। যেখানে সেই দেশের সম্পদ এর বিপরীতে বেশি পরিমাণে টাকা ছাপানোর ফলে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে এবং মানুষকে গাড়িতে করে টাকা নিয়ে গিয়ে বাজার করে আনতে হয়। সে দেশে পরিস্থিতি এমন হয়ে গিয়েছে যে, সেখানে বর্তমানে বিলিয়ন কিংবা ট্রিলিয়ন পরিমাণ টাকার নোট পাওয়া যায়। কেননা সেখানে টাকার বিপরীতে দেশের ভেতরে অতিরিক্ত কোনো সম্পদ নেই, যে কারণে সেসব দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাবার কারণে সরকারকে বেশি পরিমাণ টাকার নোট ছাপাতে হচ্ছে।
এবার আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে সরকার কেন বেশি পরিমাণে টাকা ছাপিয়ে রাতারাতি পদ্মা সেতু কিংবা মেঘনা সেতুর মতো বড় বড় প্রকল্প তৈরি করে না কিংবা করতে পারেনা। যদি বেশি পরিমাণে টাকা ছাপাতে হবে সেই টাকা শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার এর মাধ্যমে আবার ঘুরে এসে মূল ধারার অর্থনীতিতেই প্রবেশ করবে এবং দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে দিবে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে দেশের প্রত্যেকটি দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যায় তেমনি ভাবে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকার যদি অতিরিক্ত টাকা প্রিন্ট করে তবে কিভাবে দেশের অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় চলে যায় সেটি জানেন কি? যদি আপনি এটি না জেনে থাকেন তবে জানিয়ে দিচ্ছি।
মুদ্রাস্ফীতি এর কারণে সঞ্চয় এর মূল্য কমে যায়। মনে করুন, আপনি ২০ টাকা দিয়ে কোন পন্য না কিনে সেটি ব্যাংকে রাখলেন। এবার যদি দশ দিন পর গিয়ে দেখেন যে সেই পণ্যটির মূল্য ৫০ টাকা, তবে সঞ্চয়ের ব্যাপারটায় নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা হলো। বরং আপনি যদি সেই পণ্যটি প্রথম দিনই কিনে রাখতেন তবে আজকের দিনে আপনি বরং সেই পণ্যটি ৫০ টাকায় অন্য কারো কাছে বিক্রি করতে পারতেন। যেখানে ১০ দিন আগে ও আপনার কাছে ৫০ টাকার সমপরিমাণ মূল্যের সম্পদ ছিল সেখানে দশ দিন পরে গিয়ে সেটি ২০ টাকা মূল্যের সম্পদের দাঁড়িয়ে যাবে।
আপনি এই উদাহরণটি কে ভালোভাবে বুঝেছেন কিনা সেটি আমি জানিনা। তবে এই বিষয়টি আরও ভালোভাবে আপনাকে বোঝানো যাক। ধরুন আজকের দিনে আপনি স্বর্ণ কিনবেন, যেখানে প্রত্যেক ভরি স্বর্ণের মূল্য ১০০০ টাকা। এবার আপনি সেই স্বর্ণ টি না কিনে সেটি যদি ব্যাঙ্কে রেখে দিলেন। এবার একমাস পরে গিয়ে দেখা গেল স্বর্ণের মূল্য মুদ্রাস্ফীতি এর কারণে প্রত্যেক ভরি হয়ে গিয়েছে ২০০০ টাকা।
এক্ষেত্রে আপনার কিরকম লোকসানের সম্মুখীন হতে পারেন? দেখা গেল যে সেই ব্যাংকটি আপনাকে এক মাসে সেই টাকায় হয়তোবা কিছু পরিমাণ লাভ দিয়েছে। কিন্তু একমাস পরে গিয়ে সেই স্বর্ণের দাম দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে তখন আপনাকে স্বর্ণ কিনতে হলে দ্বিগুণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু আপনি যদি সেই প্রথম মাসেই ব্যাংকে টাকা না রেখে এক ভরি স্বর্ণ কিনে নিতে হবে ১০০০ টাকা তেই পেয়ে যেতেন। এবার একমাস পরে স্বর্ণ টি কিনলে আপনি সেই টাকাতে মাত্র হাফ ভরি স্বর্ণ পাচ্ছেন।
সেই ব্যাংক আপনাকে হয়তো বা সর্বোচ্চ ১০ পার্সেন্ট লাভ দিয়েছে। কিন্তু সেই দশ পার্সেন্ট লাভ হয় আপনার টাকা হয়ে গিয়েছে ১১০০ টাকা, কিন্তু সে টাকা দিয়ে আপনি পূর্বের মত আর কোন সম্পদ কিনতে পারবেন না। কেননা সেই সময়ে সম্পদের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এভাবে করে যদি এক মাসে প্রত্যেকটি পণ্যের দাম বেড়ে যায় তবে আপনার সঞ্চয় করা অর্থ এর দামও কমে যাবে। কেননা আপনি প্রথম মাসে সেই টাকা দিয়ে যত পরিমাণ সম্পদ কিনতে পারতেন, পরবর্তী মাসে সঞ্চয় করার কারণে আর সেটি পাবেন না।
এখানে আপনি যদি প্রথম মাসেই সেসব সম্পদ গুলো কিনে রাখতেন তবে পরবর্তী মাসে আবার সেটি অন্য কারো কাছে সে অনুযায়ী বিক্রি করতে পারতেন। যেখানে আপনার অতিরিক্ত লাভ থাকতো টাকার বিপরীতে। কিন্তু এক্ষেত্রে সঞ্চয় হয়ে গেছে আপনার অর্থ হ্রাস পাবার মূল কারণ। তাহলে এবার আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, মুদ্রাস্ফীতির কারণে আপনার সঞ্চিত অর্থ এর মূল্য কিভাবে কমে যেতে পারে। বরং আপনি যদি সেই টাকাটি দিয়ে কোন কিছু কিনে রাখেন তবে পরবর্তী সময়ে সেটি বর্তমান দামে বিক্রি করতে পারতেন।
আপনাদের মধ্যে অনেকেই হয়তোবা বন্ড এর নাম শুনেছেন। আমরা হয়তো বা কেউ কেউ বন্ড কিনেছি অথবা কাউকে কিনতে দেখেছি। সরকার বন্ড বিক্রি করার মাধ্যমে মূলত আমাদের কাছ থেকে অর্থ ধার করে। যেখানে বন্ড কেনার মাধ্যমে আমাদের কোন লোকসান হয় না, কেননা আজকে পঞ্চাশ টাকার বন্ড বিক্রি করে এক বছর পর সরকার ঠিকই আবার ৫০ টাকা ফেরত দিচ্ছে, ব্যাপারটি ঠিক এরকমই। এবার সরকার এর কাছ থেকে ৫০ টাকার বন্ড পেলেন এবং এক বছর পর সেটি ফেরত পাবার পর যদি দেখেন মুদ্রাস্ফীতির কারণ এ ৫০ টাকায় আগের চাইতে কম পরিমাণে চাল কিনতে পারছেন তবে স্বাভাবিকভাবেই বন্ড কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। আবার বন্ড কেনা থেকে মানুষের বিরত থাকলে সরকারও নির্দিষ্ট অর্থ পাওয়া থেকে বিরত থাকবে।
দেশের জন্য অতিরিক্ত টাকা ছাপানো হলে টাকার বিপরীতে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাবে এবং এতে করে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হঠাৎ করে কমে যেতে পারে। আর এই মুদ্রাস্ফীতির অনিশ্চয়তার কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আর এক্ষেত্রে ব্যবসা খাতেও অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। যে দেশে মুদ্রাস্ফীতি হবে সেই দেশের মুদ্রার দাম অন্য দেশের মুদ্রার দামের চাইতে কমে যাবে। ধরুন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মুদ্রাস্ফীতির হার দিনে ০%, আর আমাদের দেশে ১০%। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে মুদ্রার দাম হবে ১২০ টাকা, যেটি ভারতে ১০০ টাকায় থাকবে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের ১.২ টাকা হবে ভারতের ১ টাকার সমান।
এভাবে করে কোন একটি দেশের মুদ্রাস্ফীতির কারণে সেই দেশের মুদ্রার মূল্য কমে যায় অন্যান্য দেশের মুদ্রার চাইতে। যেমনটি উপরের উদাহরণে আমরা জিম্বাবুয়ের মুদ্রাস্ফীতির কথা আলোচনা করেছি। যেখানে একটি রুটি কেনার জন্য ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে যেতে হয়। যে কথাটি খুব একটা ভুল ও নয়। যেখানে বিলিয়ন কিংবা ট্রিলিয়ন জিম্বাবুয়ান ডলার ডাল ভাতের মত। এবার তাহলে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, দেশের সম্পদ এর চাইতে অতিরিক্ত টাকা ছাপানো হলে সে দেশকে কি পরিমান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
অতিরিক্ত ছাপা হওয়া টাকা দিয়ে যে দেশেই তা খরচ করেন তা আবার ঘুরে ফিরে নিজের দেশে চলে আসবে। কেননা এ দেশের মুদ্রা তো আবার এ দেশে ফেরত চলে আসবে, কেননা সেগুলো অন্য দেশে ব্যবহার হবে না এবং সেগুলো এদেশেই ব্যবহার করতে হবে এদেশের মানুষকেই। একটি দেশের মুদ্রা দিয়ে অন্য একটি দেশে তো আর কেনাকাটা করা যায় না। তাই বাড়তি টাকা ঘুরে-ফিরে আবার আমাদের দেশের অর্থনীতিতেই প্রবেশ করবে। এখানে আমাদের দেশের ছাপানো টাকা দিয়ে কিন্তু বৈদেশিক ঋণ শোধ করা যায়না।
তাই এক্ষেত্রে আমরা এটিকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য ও ব্যবহার করতে পারছি না। ঋণের টাকা পরিশোধ করার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট কারেন্সিতে তা পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা থাকে। এক্ষেত্রে তা হতে পারে ডলার।
একটি দেশের উন্নয়ন করার জন্য সেই দেশে বেশি করে টাকা ছাপানো কোন সমাধান না। কোন দেশের উন্নয়ন করার জন্য সেই দেশের দরকার বেশি বেশি উৎপাদন করা। এর ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে যাবে। যদি কোন দেশের সরকার চায় যে বেশি করে টাকা ছাপিয়ে দেশের উন্নয়ন করবে, তবে সেটি সম্ভব নয়। আর যদি এভাবে করে উল্টা ভাবে দেশের উন্নয়ন করতে চায় তবে দেশের উন্নয়ন ও উল্টোভাবেই হবে।
তো বন্ধুরা ছোটকাল থেকে ভেবেও যে প্রশ্নের উত্তর আপনারা পাননি, আজ সেটির উত্তর হয়তোবা আপনারা অনেকেই বুঝতে পেরেছেন। যদি আপনারা সেই প্রশ্নের উত্তরটি পেয়ে যান তবে নিচের টিউনমেন্ট বক্সে হ্যাঁ লিখুন এবং টিউনটি কেমন লাগল তা আমাকে জানান। সেইসঙ্গে আজকের এই টিউনটি আপনার কাছে ভাল লেগে থাকলে জোসস করে দিতে ভুলবেন না এবং অনেক অনেক শেয়ার করে অন্যদের দেখার সুযোগ করে দিবেন। আর যদি আজকের এই টিউনটি আপনার কাছে ভাল না লেগে থাকে তবে আমাকে ফলো করে রাখতে পারেন, কেননা ভবিষ্যতে তো আপনাদের জন্য এর চাইতে আরো ভালো কোন টিউন নিয়ে আসতে পারি। এছাড়া আপনাদের একটি জোসস আমাকে নতুন নতুন টিউন করার উৎসাহ যোগাবে।
আর এরকম অনেক নিত্যনতুন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভিত্তিক নানা টিউন দেখতে পছন্দ করে থাকলে আমাকে ফলো করে রাখুন। দেখতে থাকুন টেকটিউনস, আমার পরবর্তী টিউন নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত।
টাকা মানুষের কাছে একটি বিনিময়ের মাধ্যম হলেও এটির কোন মূল্য নেই। বরং মূল্য রয়েছে সেই সম্পদটির এবং যেটিকে আমরা সেই টাকার বিনিময়ে ক্রয় করতে পারি। এখানে সময়ের সঙ্গে সেই সম্পর্কের মূল্য যেতে হবে সে অনুযায়ী আমাদেরকে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। আমরা যখন আমাদের দেশের শ্রম কিংবা কোনো সেবা দিয়ে কোন কিছু উৎপাদন করি তখন সেটির মূল্য নির্ধারণ করে দেশের সরকার টাকা তৈরি করে। এভাবে করে দেশের মোট সম্পদ এবং সেবার মূল্য অনুযায়ী দেশের ভিতরে থাকা মোট টাকা এর ভারসাম্য বজায় থাকে।
যদি দেশের সরকার বেশি পরিমাণে টাকা তৈরি করে তবে তা ও হয়ে যাবে সেই দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের মূল কারণ। আশা করছি আপনারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। আজকের এই টিউন থেকে তবে এখানেই বিদায় নিচ্ছি। আসসালামু আলাইকুম।
আমি মো আতিকুর ইসলাম। কন্টেন্ট রাইটার, টেল টেক আইটি, গাইবান্ধা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 4 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 421 টি টিউন ও 93 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 62 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 3 টিউনারকে ফলো করি।
“আল্লাহর ভয়ে তুমি যা কিছু ছেড়ে দিবে, আল্লাহ্ তোমাকে তার চেয়ে উত্তম কিছু অবশ্যই দান করবেন।” —হযরত মোহাম্মদ (সঃ)