বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে আমরা প্রায় সকল কাজেই এখন তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে আসছি। অনান্য সকল সেক্টরের মতোই এনার্জি বা শক্তির উৎপাদনের ক্ষেত্রেও আমরা গত কয়েক বছর ধরে তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়া দেখতে পাচ্ছি। আমরা কিন্তু নতুন করে এনার্জি তৈরি করতে পারবো না কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা প্রকৃতি থেকে যে শক্তি পাচ্ছি যেটাকে কাজে লাগিয়ে আমরা আবারো এনার্জি তৈরি করতে পারি। এটাকে Renewable Energy বা বাংলায় যাকে আমরা নবায়নযোগ্য শক্তি হিসেবে চিনে থাকি। আর এই জাতীয় এনার্জিগুলো আমরা সাধারণত সুর্যরশ্মি, বাতাস, বৃস্টি এবং জিওথার্মাল হিট থেকে পেয়ে থাকে। এই শক্তিগুলো আমাদের বর্তমান জীবনের চারটি সেক্টরে ব্যবহার করা হয় সেগুলো হলো ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন, বাতাস এবং পানি হিটিং এবং কুলিং, ট্রান্সর্পোটেশন এবং অফ-গ্রিড এনার্জি সার্ভিস।
পুরো বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ৭.৭ মিলিয়ন জবস এই নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য তৈরি হয়েছে। আর আপনি জানেন কি পৃথিবীর দুটি দেশ, আইসল্যান্ড এবং নরওয়ে ইত্যিমধ্যে তাদের সকল ইলেক্ট্রিসিটি এই নয়ায়নযোগ্য শক্তির সাহায্যে উৎপাদন এবং ব্যবহার করে আসছে এবং এটা অনান্য দেশেও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
যেমন ২০৫০ সালের মধ্যে অনেক দেশই তাদের সকল এনার্জি সাপ্লাই (ইলেক্ট্রিসিটি, মোবাইলিটি এবং হিটিং/কুলিং) কে ১০০ ভাগ নবায়নযোগ্য শক্তির উপর নির্ভরযোগ্য গড়ে তোলার জন্য ইতিমধ্যে কাজশুরু করে দিয়েছে। উন্নত দেশগুলোর সাথে সাথে উন্নয়নশীল দেশ এবং অন্নুত দেশগুলোতেও ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার শুরু হচ্ছে। আর অন্নুত এবং উন্নয়নশীয় দেশগুলোতে এই নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে মূলত ইলেক্ট্রনিকের সরবারহ আরো সহজযোগ্য হয়ে উঠবে এবং এতে করে তারা ধীরে ধীরে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সহযোগীতা করতে পারবে। কারণ এই নবায়নযোগ্য শক্তির সাহায্যে প্রধানত ইলেক্ট্রিসিটিতে ব্যবহার করা হবে, আর আমরা সহজেই ইলেক্ট্রিসিটিকে তাপশক্তিতে রূপান্তর করতে পারি আর তাপশক্তিকে আমরা অনান্য কাজে ব্যবহার করতে পারি। উন্নত বিশ্বে ২০২০ সালের মধ্যে কয়েল এবং তাপশক্তি উৎপাদনে তেলের ব্যবহার একদমই বন্ধ হয়ে যাবে এই নবায়নযোগ্য শক্তি আর প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহারের কারণে। তাই দিন দিন নবায়নযোগ্য শক্তি সিস্টেমগুলো কম দামে এবং বেশি কার্যকর হয়ে উঠছে।
নবায়নযোগ্য শক্তি মূলত আসে সূর্যের আলো থেকে, এছাড়াও এটিকে বাতাস, জিওথার্মাল হিট, হাইড্রোপাওয়ার, বায়োম্যাস, বায়োফুয়েলস থেকেও সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। নবায়নযোগ্য শক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা পরিবেশকে সুন্দর এবং দুষণমুক্ত রাখতে পারি। আর নবায়নযোগ্য শক্তির মূল উৎস হলো সূর্যের আলো তাই বলা হয়ে থাকে যে আগামী ১ বিলিয়ম বছর পর্যন্ত নবায়নয়োগ্য শক্তির কোনো কমতি হবে না। এছাড়াও নবায়নযোগ্য শক্তির সঠিক ব্যবহার না করা হলে বিজ্ঞানীদের মতে বলা হয়েছে যে ভবিষ্যৎতে এমন একটি সময় আসবে যখন সূর্য পৃথিবীর অনেক কাছে চলে আসবে তখন পৃথিবীতে ঠান্ডা পানির অস্তিত থাকবে না। কিন্তু নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে আমরা সূর্যের আলো সঠিক ব্যবহার করতে পারি।
বিগত কয়েক বছরে ক্লাইমেট চেঞ্জ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে আলোচনা, তেলের উচ্চমূল্য বৃদ্ধি, বিভিন্ন দেশের সরকারের সার্পোট এবং নবায়নযোগ্য শক্তির সাহায্যে চালিত গাড়ির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই। বর্তমানে ৪৪ মিলিয়নের বেশি বাসায় বায়োগ্যাস দিয়ে রান্নার কাজ হচ্ছে, অন্যদিকে প্রায় ১৬৬ মিলিয়নের বেশি ঘরে ব্যবহার করা হচ্ছে ব্যায়োম্যাস কুকস্টোভ। এছাড়াও বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশের প্রায় ২০% বেশি লোক এখন প্রতিদিন নবায়নযোগ্য শক্তির সিস্টেম ব্যবহার করে থাকে।
১৯০০ শতকের মাঝামাঝিতে কয়লাশক্তির উদ্ভাবন হওয়াতে তখন থেকেই প্রকৃতিগত সকল এর্নাজিই নবায়নযোগ্য হয়ে উঠেছিল। তবে মানবজাতি ঠিক কখন থেকে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করা শুরু করে সেটা সঠিক করে বলা সম্ভব নয়। তবে আজ থেকে প্রায় ৭৯০, ০০০ আগে মানুষ যখন দুটো পাথর কিংবা দুটি শুকনো গাছে ডাল দিয়ে আগুন ধরানো শুরু করে ঠিক তখন থেকেই মানুষ নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারও একই সাথে শুরু করে। তবে নবায়নযোগ্য শক্তির সঠিক ভাবে ব্যবহার শুরু হয় আজ থেকে ২০০ কিংবা ৪০০ বছর আগে যখন সমুদ্রে ভ্রমণ করার জন্য জাহাযে সামুদ্রিক বাতাসের সাহায্যে পালের ব্যবহার শুরু হয়। তবে বাতাসের সাহায্যে নৌকা বা এই জাতীয় টান্সর্পোটেশনের ব্যবহার আমরা ৭০০০ বছর আগেও দেখতে পাই।
তবে ১৮৬০ এবং ১৮৭০ এর দশক থেকেই পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা মানুষের দৈন্যদিন জীবনের কাজগুলোর জন্য আলাদা এনার্জি রিসোর্স খুঁজে বের করার চেষ্টা শুরু করেন কারণ তারা ভয় পেতে থাকেন যে এই পরিমাণে প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহৃত হতে থাকলে ভবিষ্যৎতে আর ব্যবহার করার মতো কিছুই থাকবে না।
পৃথিবীতে সর্বপ্রথম সোলার ইঞ্জিন নির্মিত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরেই। আর ১৯১১ সালে সোলার এনার্জির গুরুর্ত্ব মানুষ প্রথম বুঝতে পারে। এছাড়াও Peak Oil এর থিউরি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে। এছাড়াও ১৯৭০ এর দশকে পরিবেশবাদীরা প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেলের উপর চাপ কমাতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের উপর বিভিন্ন কর্মসুচি শুরু করে দেন। এছাড়াও ওই দশকে প্রথম ইলেক্ট্রনিক উৎপাদনকারী বাতাসের সাহায্যে চালিত Wide Mill বা Wind Turbines এর ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু ২০০০ সাল পর্যন্ত ঘরে ঘরে নবায়নযোগ্য শক্তি সিস্টেম ব্যবহার শুরু হয়নি কারণ তখন পর্যন্ত এটি অনেক দামী একটি সিস্টেম ছিলো।
আর সর্বশেষে ২০১৪ সালে The IEA 2014 World Energy Outlook Project নবায়নযোগ্য শক্তির ১৭০০ গিগাওয়ার্টস সাপ্লাইকে ২০৪০ সালের ভিতর ৪৫৫০ গিগাওর্য়ার্টসে নিয়ে আসার প্ল্যান করেছে।
বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উন্নত বিশ্বে wind turbines ব্যবহৃত হচ্ছে। বাতাসের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই wind গুলো ঘুরতে থাকে আর এরা ৬০০ কিলোওয়াট থেকে শুরু করে প্রায় ৫ মেগাওয়াট রেটের বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। তবে ১.৫ থেকে ৩ মেগাওয়াটের wind গুলো আজকাল বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ২০১৫ সালের বিশ্বের সবোর্চ্চ ৭.৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে একটি সিঙ্গেল wind turbines থেকে। বাতাসের সাহায্যে এক একটি Wind যত দ্রুত ঘুরবে তত বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। যেসব এরিয়াতে বাতাসের গতিবেশ বেশ বেশি যেসব এরিয়াতে এই Wind Power টেকনোলজিটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার জন্য।
আর এই টেকনোলজি থেকে বিশ্বের মোট বিদ্যুৎতের ৪% চলে আসে। ২০১৫ সালে wind power প্রজেক্ট থেকে বিশ্বে প্রায় ৬৩ গিগাওয়াটস বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। আর বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা এবং কানাডার গ্রাম্য অঞ্চলের প্রধাণ বিদ্যুৎ সরবরাহকারী হিসেবে wind turbines ব্যবহৃত হচ্ছে। পৃথিবীর সকল সঠিক স্থানে যদি এই টেকনোলজি বসানো যেতে পারে তাহলে বিশ্বের নিত্যদিনের বিদ্যুৎতের প্রায় ৪০% এই wind power টেকনোলজি থেকে সেটা পূরণ করা সম্ভব হবে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।
২০১৫ সালের বিশ্বের টোটাল ইলেক্ট্রিসিটির ১৬.৬ ভাগ এই হাইড্রোপাওয়ার সেক্টর থেকে উৎপাদিত হয়েছে এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ৭০ ভাগ এই হাইড্রোইলেক্ট্রিসিটি থেকে প্রতি বছর উৎপাদিত হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও পানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় কর্ণফুলি বিদ্যুৎ স্টেশনে। আর বাতাসের তুলনায় পানি থেকে বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় কারণ বাতাসের থেকে পানি ৮০০ গুণ বেশি ঘণ হয়ে থাকে আর তাই কম স্রোতের পানি কিংবা শান্ত সমুদ্রের পানি থেকেও অনেক পরিমাণের বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই Dam এর মাধ্যমে পানি থেকে এই হাইড্রোপাওয়ার ইলেক্ট্রিসিটি উৎপাদন করা হচ্ছে। তবে Dam ব্যবস্থাটি অনেক পুরোনো টেকনোলজি হলেও অনেক দেশেই এটি এখনো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশ্বের বৃহৎতম Dam হচ্ছে চীনের Three Gorges Dam এবং ব্রাজিল এবং প্যারাগুয়ের তৈরি Itaipu Dam।
আর এছাড়াও ছোট ছোট আকৃতির হাইড্রোসিস্টেম দিয়ে ৫০ মেগাওয়ার্টের বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। চীন দেশে এরকম ছোট ধরনের প্রায় ৪৫ হাজার হাইড্রোসিস্টেম রয়েছে। আর সর্বশেষে ছোট ছোট নদীর স্রোত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার জন্য রয়েছে Run-of-the-river-hydroelectricity প্ল্যান্টস যেটি আমাদের দেশেও রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশে হাইড্রোপাওয়ার ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়ে থাকে। আর চীন হলো বিশ্বের সবথেকে বড় হাইড্রোপাওয়ার জেনারেটর দেশ।
সোলার এনার্জি হলো নবায়নযোগ্য শক্তি সিস্টেম অন্যতম বহুল ব্যবহৃত একটি টেকনোলজি, এবং সোলার এনার্জি সম্পর্কে আমরা অনেকেই জেনে থাকবো। সোলার এনার্জি সূর্যের আলো এবং তাপ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। বর্তমানে সোলার এনার্জির মধ্যে Solar heating, photovoltaics, concentrated solar power (CSP), concentrator photovoltaics (CPV), solar architecture এবং artificial photosynthesis সিস্টেমগুলো রয়েছে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সোলার এনার্জি সিস্টেম মাল্টি-বিলিয়ন এবং ফাস্ট গ্রোয়িং ইন্ড্রাস্টি হিসেবে গড়ে উঠেছে। আর দিনে দিনে সোলার এনার্জি ব্যবহারও যেমন বেড়েই চলেছে তেমনি এটার খরচও কমে আসছে। আর কম খরচের জন্য উন্নয়ণশীল দেশগুলোতেও এটার ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশেও অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ঘরে ঘরে এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সোলার এনার্জি সিস্টেম ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
বিগত কয়েক বছর ধরেই আমরা টিভিতে এবং বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেখে আসছি যে আমাদের দেশেও সৌরবিদ্যুৎ অনেকেই ব্যবহার করছেন। এছাড়াও দেশের কয়েকটি প্রজেক্ট আমরা বর্তমানে চলমান অবস্থায় দেখছি। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার কি সহজ? আগামী ৫০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যেই জীবাশ্ন জ্বালানীর প্রাকৃতিক রির্জাভ শেষ হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে তাই পরিবেশগত ঝুঁকি বিবেচনায় কয়লার মতো জ্বালানী ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশংকায় বিশ্বজুড়েই বিকল্প জ্বালানী হিসেবে নাবায়নযোগ্য জ্বালানীর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশে এখনো নবায়যোগ্য জ্বালানী শক্তির তেমন ব্যবহার দেখছি না।
নবায়নযোগ্য জ্বালানীকে একটি দেশের প্রয়োগ করার পূর্বে এবং জ্বালানী ব্যবস্থাপনার মূল অবকাঠামোতে সার্থকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু থেকেই প্রয়োজন কার্যকর গবেষণা। কারণ জীবনাচারণ, অর্থনৈতিক দিক, কাচাঁমালের যোগান, ভু-প্রাকৃতিক বৈচিত্রতা, আবহাওয়া এ সব কিছুকে সঠিক ভাবে অন্তর্ভূক্ত করে এ জাতীয় জ্বালানীকে সহজ ভাবে খুবই কম খরচে ব্যবহার উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে নিজস্ব গবেষণার কোনো বিকল্প হয় না। উদাহরণ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বায়ু বিদ্যুৎ ব্যবহার বিষয়ক গবেষণার কথা বলা যায়। সেখানে বাতাসের গতির বিবেচনার উপর “উইন্ড টারবাইক“ বা বায়ুকলগুলোকে কতটা ঐখানকার বাতাসে চালানোর ব্যাপারে উপযোগী করে গড়ে তোলা যায় সে গবেষনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাধান্য পাচ্ছে। সেই গবেষণার আলোকে আমাদের দেশে নিজস্ব পরীক্ষণ-পর্যবেক্ষণ ছাড়া শুধুমাত্র কারো প্রেসক্রিপশন মেনে আমদানী করা উইন্ড টারবাইন নিয়ে এসে স্থাপন করলে তা কোন ফল বয়ে আনবে না।
এই কথা নবায়নযোগ্য শক্তি সিস্টেমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আর এই জিনিসটিই করা হয়েছে রাঙ্গামাটির বরকলে স্থাপিত ৫০ কিলোওয়াটের মাইক্রো হাইড্রো প্লান্টটির ক্ষেত্রে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করার কারণে পানির সাথে বয়ে আসা নুড়ি পাথর আর মাটির কারণে এটি চালুন কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। অথচ পানির উৎসমুখে সঠিক ফিল্টারিংয়ের ব্যবস্থা করলে খুব সহজেই এটি এড়ানো যেতো। এই একটি প্রকল্পে ব্যার্থতাই অনান্য প্রকল্প শুরু হওয়ার জন্য ক্ষতিকারণ হিসেবে উঠে আসবে। আর সেটাই হয়েছে, এই ব্যর্থতার কারণে মাইক্রো বা পিকো হাইড্রোর বিষয়ে যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে তাতে করে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, চট্ট্রগ্রাম, দিনাজপুর, রংপুর, জামালপুর, সিলেট সহ বিভিন্ন স্থাথে ইতোমধ্যেই মাইক্রো বা পিকো হাইড্রোর জন্য নির্ধারিত স্থানগুলোতে কোন প্রকল্প কাজ শুরু করার কোনো উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বাংলাদেশে গবেষণা খাতটি বরাবরই অবহেলিত। এই অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশেষায়িত প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় পযন্ত বিস্তৃত। গবেষণা খাতে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা আর প্রনোদনাহীনতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গবেষকদের বিদেশী গবেষণার পরজীবি হয়ে যেতে বাধ্য করে। নবায়নযোগ্য জ্বালানী বিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রেও একই কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। এই খাতে সরাসরি সরকারের এক টাকারও বরাদ্দ নাই। ছিটে-ফোটা গবেষণাগুলোর প্রায় সবই বিদেশী কিছু সংস্থার বিশেষ চাহিদা মাফিক কিংবা ‘সিএসআর’ অনুদান নির্ভর। অথচ পাশের দেশ ভারতেই প্রতি বছর নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে খাতওয়ারী বরাদ্দ থাকে।
বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভূমিকার রাখছে কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। চট্ট্রগাম বিভাগের রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় কাপ্তাই বাঁধ তৈরি করা হয়। পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে আমেরিকার অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ শেষ হয়। এ বাঁধের পাশে ১৬টি জলকপাট সংযুক্ত ৭৪৫ ফুট দীর্ঘ একটি পানি নির্গমন পথ বা স্প্রিলওয়ে রাখা হয়েছে। এ স্প্রিলওয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক ফিট পানি নির্গমন করতে পারে। কাপ্তাই বাঁধের কারণে ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি ডুবে যায় যা ঐ এলাকার মোট কৃষি জমির ৪০ শতাংশ, এর ফলে সৃষ্টি হয় কাপ্তাই হ্রদ। ১৯৬২ সালে এটির নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার পর এতে দুটি ৪০ মেগাওয়াটের জেনারেটর স্থাপন করা হয়। ১৯৬৯ সালের ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৩ নম্বর ইউনিটের কাজ শুরু হয়। ৩ নম্বর ইউনিটের কাজ ১৯৮২ সালে শেষ হয়। ৪র্থ ও ৫ম ইউনিটের কাজ শেষ হয় ১৯৮৮ সালে। বর্তমানে মোট পাঁচটি ইউনিট চালু আছে যার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। পানির প্রবাহ ছাড়া আর কোন জ্বালানি না লাগায় কাপ্তাই কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশের একমাত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতি ইউনিটে খরচ হয় ২৫ পয়সারও কম। কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রেটিকে ২০১৫ সালের জাতীয় শ্রেষ্ঠ বিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়, যা ছিল সর্বোচ্চ ও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বীকৃতি।
জলশক্তি ছাড়াও বাংলাদেশে রয়েছে বায়ুশক্তির ব্যবহার। বায়ুর গতিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে জেনারেটরের টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এ ক্ষেত্রে বায়ু যখন টারবাইনের ব্লেডের মধ্যে দিয়ে যায় তখন বায়ুর গতিশক্তি ঐ ব্লেডগুলোকে ঘুরায়। আর ঐ ব্লেডগুলোর সাথে রোটর সংযুক্ত থাকে যা ব্লেডগুলোর ঘূর্ণনের ফলে সক্রিয় হয়। এই রোটর জেনারেটরের সাথে সংযুক্ত থাকে যার ঘূর্ণনের ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
বাংলাদেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপিত হয় ফেনীর সমুদ্র উপকূলীয় সোনাগাজীতে অবস্থিত মুহুরী প্রজেক্টে। মুহুরী প্রজেক্ট হল বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। ফেনীর মুহুরী নদীর তীর ঘেঁষে খোয়াজের লামছি মৌজায় ছয় একর জমির উপর স্থাপিত এটি। মুহুরী প্রজেক্ট বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র ২০০৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অবস্থিত ৪টি ২২৫ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন টারবাইন দিয়ে প্রায় এক মেগাওয়াট (০.৯) বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
এছাড়াও ২০১৭ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ায় চালু হয় ১ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বায়ু চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। ২০ কিলোওয়াট ক্ষমতার ৫০টি টারবাইন দ্বারা ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জাতীয় গ্রীডের সাথে সংযুক্ত নয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আশে পাশের প্রায় ৫৫০ গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। সমুদ্র সৈকতের দক্ষিণে আলী আকবরের ডেল এলাকায় বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অবস্থিত। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে প্রায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি তৈরি করা হয়েছে। আর অন্য দিকে বাংলাদেশের সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর অধিকাংশ জাতীয় গ্রীডের সাথে সংযুক্ত নয়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত উৎপাদনে যাওয়া ২১১.৪৬ মেগাওয়াটের সৌর বিদ্যুতের মধ্যে ২০১.৪ মেগাওয়াট বিদ্যুতই জাতীয় গ্রীডের বাইরে। এর মধ্যে রয়েছে ৪৫ লক্ষ সোলার হোম সিস্টেম যার পরিমাণ প্রায় ১৭৮.৮৬ মেগাওয়াট। আরো রয়েছে প্রায় ৫০০টি সোলার পাম্প যাতে ব্যবহৃত হচ্ছে ৬.৪৩ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ। বাংলাদেশে ২০১৭ সালের মধ্যে ১৫৫০টি সোলার ইরিগেশন পাম্প স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিঃ।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। অন্য সকল ক্ষেত্রের মতোই নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রের আমাদের দেশে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। ২০১৭ সালে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার থেকে দেশে মোট ৪৪৫.৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। আর এর অর্ধেকই এসেছে সৌরশক্তি থেকে। ভবিষ্যৎতে সৌরশক্তির মূল্য আরো কমে আসবে এবং বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই সৌরশক্তির ব্যবহার শুরু হবে বলে আশা করা যায়।
তো এই ছিল নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে আমার আজকেই এই টিউনটি। একটা কথা আছে, যার শুরু আছে তার শেষও আছে। প্রাকৃতিক শক্তির কথাও এখানে চলে আসে। তাই আমাদেরকে এ প্রাকৃতিক শক্তি সম্পূর্ণ ফুরিয়ে ফেলার আগেই বিকল্প একটি উৎসের উপর নির্ভর করা শিখতে হবে। আর সেটাই নবায়নযোগ্য শক্তি সিস্টেমের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আরো সহজ ভাবে আমাদের দৈন্যন্দিন জীবনে ব্যবহারের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। টিউনটি সম্পর্কে কোনো মতামত থাকলে সেটা নিচের টিউমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না যেন। আগামীতে অন্য কোনো টপিক নিয়ে আমি টিউনার গেমওয়ালা চলে আসবো আপনাদেরই প্রিয় বাংলা টেকনোলজি ব্লগ টেকটিউনসে। টিউনটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আমি ফাহাদ হোসেন। Supreme Top Tuner, Techtunes, Dhaka। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 12 বছর 11 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 661 টি টিউন ও 428 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 149 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
যার কেউ নাই তার কম্পিউটার আছে!