তথ্য প্রযুক্তি এই যুগে ব্যাটারির অবদান কতটুকু সেটা হয়তো আপনাদেরকে আর নতুন করে বুঝাতে হবে না। প্রায় অধিকাংশ ইলেক্ট্রনিক গেজেডে ব্যাটারি রয়েছে প্রাণশক্তি হিসেবে। আর আমি আজ ব্যাটারি নিয়ে কিছু আলোচনা করতে টেকটিউনসে চলে আসলাম। ব্যাটারি নিয়ে আলোচনার শুরুতেই এর ইতিহাস নিয়ে কিছু বলা যাক।
১৮০০ শতকে Alessandro Volta সর্বপ্রথম কার্যকরি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ব্যাটারি তৈরিরে সক্ষম হন। তিনি কপার এবং জিন প্লেটগুলোকে ব্রিন-সোক পেপার ডিস্কের মাধ্যমে একত্র করে কিছুক্ষণের জন্য ভলটেজ ধরে রাখতে সক্ষম হন! এই ভলটেজ ধরে রাখাকে ভলটেজ পাইল নামে আখ্যায়িত করা এবং এই পদ্ধতিতেই পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ ব্যাটারির আবিস্কার করা সম্ভব হয়।
পরবর্তীতে ১৮৩৬ সালে John Frederic Daniell ব্যাটারির জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড ডিজাইন করেন। তিনি কপার পট আর কপার সুলপ্লেটকে সঠিকভাবে সাজিয়ে একটি আদর্শ ব্যাটারীর মডেল দাঁড় করান, পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা তাদের নিজস্ব থিউরী এই মডেলের উপর প্রয়োগ করে ধীরে ধীরে ব্যাটারির উন্নয়ন হতে থাকে। এদিকে ১৯৭৯ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির John Goodenough এবং Koichi Mizushima প্রথম একটি রিচার্জেবল সেল উদ্ভাবন করেন।
এটি ৪ ভল্ট রেঞ্জের একটি ব্যাটারি ছিল যেটায় পজিটিভ ইলেক্ট্রকোড হিসেবে লিথিয়াম কবাল্ট অক্সসাইড কে এবং নেভেটিভ হিসেবে লিথিয়াম মেটালকে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এই প্রযুক্তির ব্যাটারিকে সর্বপ্রথম ১৯৯১ সালে কমার্শিয়াল রূপে সনি (sony) কোম্পানি তাদের পোর্টেবল ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসে ব্যবহার করা শুরু করে।
আমাদের বর্তমান যুগের পোর্টেবল টেকনোলজি ডিভাইসগুলোতে ইলেক্ট্রকেমিক্যাল সেলস এর মাধ্যমে পাওয়ার প্রদানকারী ব্যাটারিগুলোকে মর্ডান ব্যাটারি বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। আমাদের মর্ডান ব্যাটারিগুলো সাধারণত দুই প্রকার।
১) সিঙ্গেল ইউজ: একবার ব্যাটারি ব্যবহারের পর তা আর পুনরায় ব্যবহার করা যায় না, ফেলে দিতে হয়।
২) রিচার্জেবল: বারবার ব্যবহারযোগ্য ব্যাটারি এটি। যেখানে ইলেক্ট্রকোড এর ব্যবহারের মাধ্যমে রিচার্জ এর ফিচার রয়েছে।
অধিকাংশ মর্ডান ব্যাটারিগুলো lithium-ion (Li-ion) সেল ব্যবহার করে থাকে। আবার কিছুকিছু জায়গায় lithium-polymer (Li-Po) সেলও ব্যবহার হয়। লিওন সেলের থেকে লিপো সেলের ব্যাটারিগুলোতে পাওয়ার কম থাকে কিন্তু এটা লিওন ব্যাটারিগুলোর তুলনায় ওজনে হালকা, ফেক্সিবল ডিজাইন এবং এগুলো সহজে হিট হয় না।
লিওন ব্যাটারিগুলোতে লিথিয়াম কবাল্ট অক্সাইড (LiCoO2), Graphite এবং Organic Solvent সমূহকে ইলেক্ট্রলাইট হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
লিথিয়াম প্রযুক্তির ব্যাটারিগুলো বর্তমান যুগে পোর্টেবল টেকনোলজির পাওয়ার সোর্স হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কারণ এইজাতীয় ব্যাটারিগুলো রিচার্জেবল এবং উচ্চ পাওয়ার সোর্স ধরে রাখতে সক্ষম। লিওন ব্যাটারি চাজিং এর সময় ব্যাটারির পজিটিভ লিথিয়াম কবাল্ট অক্সাইড ইলেক্ট্রকোডটি নেগেটিভ গ্রাফিট ইলেক্ট্রকোডে পরিবর্তিত হয়ে যায়। আর চাজিং না হলে বা ব্যাটারির ব্যবহারের সময় লিওন ব্যাটারি তার নেগেটিভ থেকে পজিটিভ প্রক্রিয়ায় চলে আসে। এই প্রক্রিয়াটি ৩.৭ ভোল্টের হাই-ভোল্টেজের কারেন্টের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
লিথিয়াম ব্যাটারিগুলোকে বড়সড় কম্পাউন্ডে বসিয়ে ল্যাপটপের ব্যাটারি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ল্যাপটপের ব্যাটারিগুলো একসাথে অনেকগুলো সেলসের চাজিং/ডিসচাজিং এর কাজ করে বিধায় চাজিং এর সময় একটু খেয়াল রাখতে হয়। ল্যাপটপের ব্যাটারিতে টেম্পারেচর সেন্সসর থাকে যেটি ব্যাটারির হিটকে মনিটর করে, একটি ভল্টেজ রেগুলেটর থাকে যার কাজ হচ্ছে ব্যাটারিতে থাকা সকল সেলসগুলোতে সঠিক পরিমাণের কারেন্ট সরবরাহ করা, একটি ব্যাটারি চার্জ স্টেট থাকে যেটির মাধ্যমে ল্যাপটপে কতটুকু চার্জ রয়েছে সেটি শতকরা হিসেবে আপনাকে দেখাবে।
আমাদের মর্ডান লিথিয়াম ব্যাটারির ভিতরের পজিটিভ ইলেক্ট্রকোড সেলসগুলো নস্ট হয়ে গেলে পুরো ব্যাটারি কার্যক্ষমতা আস্তে আস্তে কমে যেতে পারে এবং একসময় ব্যাটারি অকেজো হয়েও যেতে পারে। ব্যাটারির ক্ষতি বা ব্যাটারির ক্ষয়ের জন্য প্রধানত তিনটি কারণ রয়েছে। সেগুলো হলো:
১। হিট (Heat) :
ব্যাটারী ক্ষয়ের প্রধাণ কারণ হচ্ছে ব্যাটারি হিট হওয়া বা ব্যাটারি গরম হওয়া। অতিরিক্ত গরম ব্যাটারির জীবনায়ু ধ্বংস করে দিতে পারে এমনকি বেশি প্রেসারের জন্য শর্ট-সার্টিকের মাধ্যমে ব্যাটারি বিস্ফোরিত হতেও পারে! প্রতিটি লিথিয়াম প্রযুক্তির ব্যাটারিগুলোর সেলসের ভিতর একটি সেপারেটর দেওয়া থাকে। এই সেপারেটরের কাজ হলো চাজিং / ডিসচাজিং এর সময় ব্যাটারির সেলসগুলোকে পজিটিভ/নেগেটিভ ইলেক্ট্রকোডে পরিবর্তন করা। যখন এই সেপারেটর ক্ষতিগ্রস্থ হয় তখন ইলেক্ট্রকোডগুলো মুক্তভাবে ব্যাটারির সেলসগুলোর ভিতর ঘুরতে থাকে। এই উদ্দেশ্যহীন ভাবে সেলসের চলাচলের কারণে ব্যাটারি অতিরিক্ত হিট হয় এবং এভাবে চলতে থাকলে ব্যাটারি বিস্ফোরনের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
ব্যাটারি হিট হওয়া বা গরম হওয়া থেকে রক্ষা পেতে সরাসরি সূর্যের আলোর ভিতর ডিভাইস ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন, আপনার ডিভাইসের ক্ষমতার বাহিরে গিয়ে কোনো অ্যাপস, গেমস ইত্যাদি চালাবেন না, ডিভাইসে ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় চাজিং করা থেকে বিরত থাকুন এবং সবথেকে বড় কথা, আপনার ডিভাইসের ব্যাটারির চাজিং ক্ষমতা অনুযায়ী সঠিক ভল্টেজের কারেন্ট ব্যবহার করে ব্যাটারি চার্জ দিন।
২। অনেকদিন চার্জ না দেওয়া:
লিথিয়াম প্রযুক্তির ব্যাটারিগুলোতে কোনো প্রকার চার্জ মেমোরী দেওয়া থাকে না। এই কারণে লিথিয়াম ব্যাটারিগুলো দীর্ঘদিন চার্জ না দিলে সেগুলোর সেলস ক্ষয় হতে যেতে পারে। তাই আপনি দেখবেন যে, দোকানগুলোতে নতুন ডিভাইসের ব্যাটারিগুলো হালকা চার্জে দেওয়া থাকে। কারণ চার্জবিহীন ব্যাটারি বা ফুলচার্জ দেওয়া ব্যাটারি বেশিদিন অব্যবহৃত থাকলে ব্যাটারির নস্টের সম্ভাবনা থাকে।
৩। ব্যাটারির বয়স:
লিথিয়াম ব্যাটারিগুলো প্রধানত চাজিং এর উপর তার আয়ুকাল নির্ভর করে। সাধারণত একটি লিথিয়াম ব্যাটারির সর্বোচ্চ আয়ুকাল ২ থেকে ৪ বছর হয়ে থাকে। আপনার একটি ব্যাটারি ১ বছরও যেতে পারে আবার একই ব্যাটারি আরেকজনের ২ বছরও যেতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যাটারিটি কতবার চার্জ দেওয়া হয়েছে সেটা প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
বয়স হচ্ছে ব্যাটারি ক্ষয়ের প্রধান ৩টি কারণের শেষ কারণ। বেশি বয়সের ব্যাটারি স্বভাবতই কম সার্ভিস দেবে একটি নতুন ব্যাটারির তুলনায়। তাই কোনো নতুন ডিভাইস কেনার সময় তার ব্যাটারির বয়স চেক করে নেওয়া জরুরী। নতুন ডিভাইস কেনার সময় যদি দেখেন যে ব্যাটারি উৎপাদনের তারিখ আরো এক বছর আগে দেওয়া রয়েছে তাহলে অবশ্যই আপনি ডিভাইস মেনুফেকচারদের কাছ থেকে নতুন ব্যাটারি চেয়ে নেবেন।
প্রতিনিয়ত অনান্য গেজেডের মতোই ব্যাটারির উন্নয়নের জন্যেও বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন। কারণ ব্যাটারির উন্নয়নের উপর বাকি সকল পোর্টেবল ডিভাইসের উন্নতি নির্ভর করছে। আমরা অদূর ভবিষ্যৎতে যেসকল ব্যাটারি দেখতে পারে সেগুলো হচ্ছে:
ক) ডুয়াল কার্বন ব্যাটারি:
লিথিয়াম ব্যাটারিতে ব্যবহৃত পজিটিভ এবং নেগেটিভ টার্মিনালগুলোর লিথিয়াম অক্সাইডকে প্লেইন কার্বনের সাথে পরিবর্তন করে এই ডুয়াল কার্বন ব্যাটরির উদ্ভাবনে চেস্টা চালাচ্ছে জাপানের একটি কোম্পানি। ডুয়াল কার্বন ব্যাটারিগুলো আজকালের ব্যাটারি থেকে ২০ গুন তারাতারি চার্জ হবে! চাজিং এর সময় গরম হবে না এবং এই ডুয়াল কার্বন ব্যাটারিতে আগুন লাগার সম্ভাবনা ১০% থাকবে। আর সবথেকে ভালো দিক হলো এই ডুয়াল কার্বন ব্যাটারিগুলো কম দামে পাওয়া যাবে, এগুলো নন-টক্সিড বলে ব্যাটারিগুলো রিসাইকেলও করা যাবে। মূলত ইলেক্ট্রিক গাড়ির জন্য এই টাইপের ব্যাটারি ব্যবহার করা হবে সামনের দিনগুলোতে।
খ) লিথিয়াম এয়ার ব্যাটারি (Li-Air):
লিথিয়াম ব্যাটারির উন্নত সংস্করণ হচ্ছে এই লিথিয়াম এয়ার ব্যাটারি প্রযুক্তি। লিথিয়াম ব্যাটারিতে কেমিক্যাল অক্সাইডের পরিবর্তে অক্সিজেনের ব্যবহার করাই এই ব্যাটারির মূল লক্ষ্য। সাধারণত লিথিয়াম ব্যাটারিগুলো পোর্টেবল টেকনোলজি ডিভাইসে ব্যবহৃত হয় বিধায় এই প্রযুক্তি হচ্ছে নির্মাতাদের কাছে ড্রিম প্রজেক্টের মতো।
এই প্রযুক্তির ব্যাটারিতে বর্তমান যুগের ব্যাটারির তুলনায় ৪০ গুণ বেশি পাওয়ার ধরে রাখা যাবে। এর মাধ্যমে একবার ফুল চার্জে ইলেক্ট্রিক গাড়ি হাজার মাইল পাড়ি দিতে সক্ষম হবে। আর এই ব্যাটারির মোবাইল ফোনগুলোতে বছরে একবার চার্জ দিতে হবে! শুনতে তো ভালই লাগে! আর অক্সিজেনের ওজন কেমিক্যালের থেকে অনেক কম বিধায় এই ব্যাটারির ওজন হবে অনেক কম!
গ) Graphene Ultracapacitors:
ব্যাটারি কে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগাতে আগামী ৫০ বছরের ভিতর এই গ্রাফিন আল্ট্রাক্যাপাসিটর প্রযুক্তির ব্যাটারি বাজারে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই প্রযুক্তির ব্যাটারিগুলো ফুল চার্জ হবে মাত্র এক সেকেন্ডে এবং সিরিয়ার পরিমাণের পাওয়ার এতে স্টোর করা যাবে। দেখা যাক আগামীতে কি হয়!
টিউনটি শেষ করতে চাই একটি কথার মাধ্যমে। এই ব্যাটারির উন্নয়নের উপর আমাদের অনেক ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির ডিভাইসগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সাইজে ছোট, বেশি ধারণ ক্ষমতা এবং পরিবেশবান্ধব ব্যাটারি আমরা শীঘ্রই দেখতে পারবো বলে আশা করা যাচ্ছে। ব্যাটারি নিয়ে আপনার কোনো টিউমেন্ট থাকলে তা নিচের টিউমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। আজ এ পর্যন্তই। সবাই ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।
আমি ফাহাদ হোসেন। Supreme Top Tuner, Techtunes, Dhaka। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 12 বছর 10 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 661 টি টিউন ও 428 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 149 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
যার কেউ নাই তার কম্পিউটার আছে!