নাইট ভিশন চশমা | এক জোড়া ইলেক্ট্রনিক চোখ, কিভাবে ঘুটঘুটে রাতের অন্ধকারে দেখতে পারে? – বিস্তারিত ব্যাখ্যা! – মেগাটিউন!!!

এক সময় বাবা বলতেন; “যদি তুমি বেশি করে গাজর খাও, তবে তোমার রাতে দেখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে”। যদি এই কথা সকলে সিরিয়াস করে মানত, তবে আর্মি, সৈনিক, এবং পাইলটরা পকেট ভর্তি গাজর ছাড়া কোন মিশনে যাওয়ার কথায় ভাবত না। গাজর খাওয়ার চেয়ে নাইট ভিশন চশমা (গগল); এমন এক ইলেক্ট্রনিক চক্ষু—যা ঘুটঘুটে অন্ধকারেও দেখাতে সাহায্য করে, অনেক বেশি শক্তিশালি। এক মিনিট!… “হলিউড মুভিতে যে চশমা আর ক্যামেরা দেখানো হয়, তার কথা বলছেন? আরে, এগুলো আবার ব্যস্তবেও আছে নাকি?” হ্যাঁ! এগুলো ব্যস্তবেও কাজ করে। একটি ভালমানের নাইট ভিশন গগল, একদম মেঘাছন্ন আর জ্যোৎস্না বিহীন কালো ঘুটঘুটে রাতে ২০০ গজ পর্যন্ত দেখার ক্ষমতা প্রদান করে। তো প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কিভাবে কাজ করে? এটি কাজ করার পেছনে কোন অসাধারণ প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হয়েছে? চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক…

জন্তুরা কিভাবে অন্ধকারে দ্যাখে?

আমরা মানুষেরা, দিনের বেলায় জেগে থেকে কাজ করতে এবং রাতে ঘুমানোর জন্য তৈরি হয়েছি। আমাদের চোখের মণির পেছন দিকে এক আলোকসংবেদী পর্দা রয়েছে, একে রেটিনা বলা হয়; সেখানে রঙ্গিন আলো দেখার জন্য এক ধরনের কোষ রয়েছে যাকে কোনস (Cones) এবং অস্পষ্ট আলো ও কোন বস্তুর নড়াচড়া বুজতে পাড়ার জন্য আরেক ধরনের কোষ রয়েছে যাকে রোডস (Rods) বলা হয়। আমাদের চোখে কোনস এর চেয়ে রোডস এর সংখ্যা প্রায় ২০ গুন বেশি—১২০ মিলিয়ন রোডস এবং মাত্র ৬ মিলিয়ন কোনস রয়েছে। তারপরেও আমরা রাতে খুব একটা ভালো দেখতে পাই না।

নাইট ভিশন

অন্যান্য প্রাণীরা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে তৈরি হয়েছে। যে প্রাণীরা রাতে খুব ভালো দেখতে পায়, সাধারনত তাদের চোখের পুতলি অনেক বড় আকারের হয়ে থাকে—যাতে বেশি আলো চোখে প্রবেশ করতে পারে। কোন কোন প্রানিদের তো আবার শরীরের আকারে তুলনায় বেজায় বড় চক্ষু রয়েছে। নিশাচর প্রানিদের চোখের রেটিনায় মানুষের চোখের তুলনায় অনেক বেশি রোডস থাকে। এজন্য বিড়ালেরা দিনের চেয়ে রাতে তার শিকারের পেছনে বেশি সময় ব্যয় করে। অনেক নিশাচর প্রানিদের চোখে ট্যাপেটাম (Tapetum) থাকে—এটি অনেকটা আয়নার মতো কাজ করে। অর্থাৎ কোন আলোকে প্রতিফলিত করে আবার চোখেই পাঠিয়ে দেয়। ফলে সেই সকল প্রানিদের রেটিনায় দ্বিগুণ আলো পৌঁছে এবং আরো ভালো দেখতে সাহায্য করে। আর এই জন্যই বিড়ালেরা রাতের অন্ধকারে অনেক ভালো দেখতে পায় এবং যদি আপনি এর চোখে টর্চের আলো মারেন—তবে সেই আলো আয়নার মতো প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।

কিন্তু আমাদের মানুষের চোখে এমন কোন ব্যবস্থা থাকে না। আমাদের চোখের পুতলি মোটামুটি বড় হয়ে থাকে, কিন্তু কালো রাতে দেখার মতো বড় হয়না। আমাদের চোখে যথেষ্ট রোডস থাকে না—আমাদের চোখে কোন ট্যাপেটামও নেই। তাহলে অন্ধকারে স্পষ্ট দেখার জন্য কি করতে পারি আমরা? গাজর খেতে পারি? সারাদিন রাত গাজরের ক্ষেতে পড়ে থাকলেও কাজ হবে না। তবে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে আমরা রাতে দেখার ক্ষমতা অর্জন করতে পারি। কিন্তু কিভাবে?

নাইট ভিশন চশমা

নাইট ভিশন প্রযুক্তি বা নাইট ভিশন চশমা কিভাবে কাজ করে তা জানার আগে “আলো (লাইট)” সম্পর্কে আগে ভালোভাবে জানা প্রয়োজন। আপনি জানেন কি, প্রত্যেক প্রকারের আলো দৃশ্যমান হয়না? হ্যাঁ, একথাটি সম্পূর্ণই সত্য। আমরা যে আলোকে চোখে দেখতে পাই—একে দৃশ্যমান আলো বলা হয়—এটি আলোর সম্পূর্ণ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রামের একটি অংশ মাত্র। কিন্তু আরো অন্য প্রকারেরও আলো রয়েছে, যেমন- ইনফ্রারেড লাইট এবং আলট্রাভায়োলেট লাইট—যা আমরা কখনোয় খোলা চোখে দেখতে পাই না।

নাইট ভিশন

কোন স্থান ঘুটঘুটে অন্ধকার, মানে কিন্তু এটা নয় যে সেখানে কোনই আলো নেই। সেখানেও সামান্য কিছু আলো থাকে—ইনফ্রারেড লাইট বা আলট্রাভায়োলেট লাইট—যা সাধারণ খালি চোখে দেখতে পাওয়া যায় না। এখন মনেকরুন আপনাকে রাতে দেখতে পাওয়া যাবে এমন একটি চশমা তৈরি করতে বলা হলো, তাহলে আপনি কি করবেন? যেহেতু আলোক রশ্মি সামনের দিক থেকে চশমায় এসে পড়ে তাই প্রথমে আপনাকে সেই আলোক রশ্মিকে কোথাও থেকে ক্যাপচার করতে হবে তারপরে সেই আলোক রশ্মির শক্তি আরো বাড়িয়ে বা বুস্ট করে চশমার সামনে ফেলতে হবে, যাতে চোখ তা দেখতে পায়। কিন্তু কিভাবে আপনি আলোকে ক্যাপচার বা বুস্ট করবেন? বাইনোকুলার, টেলিস্কোপ বা আপনার চোখের সাধারন চশমা শুধুমাত্র কোন নির্দিষ্ট স্থানের দিকে আলো ফেলতে পারে, কিন্তু আলোকে আরো উজ্জ্বল করতে পারে না। আলোর উজ্জ্বলতা বুস্ট করা চশমা বানানোর চাইতে উজ্জ্বলতা কমানোর চশমা বানানো অনেক সহজ; চশমার লেন্সের উপর আলো আটকাতে পারে এমন কোন কিছু দিয়ে প্রলেপ দিলেই কাজ শেষ—ঠিক যেমনটা সানগ্লাস করে থাকে।

তবে ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহার করে কিন্তু খুব সহজেই কোন কিছুকে বুস্ট করানো সম্ভব। এক ধরনের ইলেক্ট্রিক্যাল ডিভাইজে এক প্রান্তে ছোট পরিমানের ইলেকট্রিক কারেন্ট প্রবাহ করিয়ে আরেকদিক থেকে বেশি শক্তিশালী ইলেকট্রিক কারেন্ট পাওয়া যায়; এটিকে অ্যামপ্লিফায়ার বলা হয়। উদাহরণ স্বরূপ, যখন কোন ব্যক্তি মাইকে কথা বলে—তার কণ্ঠস্বরকে ট্র্যানজিস্টর নামক একটি ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র অ্যামপ্লিফাই করে (ইলেক্ট্রনিক কারেন্ট প্রবাহ করে বাড়িয়ে দেয়, যাতে ভলিউম বাড়ানো যায়) এবং উচ্চ ভলিউমে স্পীকারে বাজানো হয়, যাতে সকলেই অনেক সহজে ব্যক্তিটির কথা বুঝতে পারে।

তো এই হলো সেই উপায়, যার মাধ্যমে চশমার আলোকরশ্মি বুস্ট করানো সম্ভব। যদি আমরা আলোকে ইলেক্ট্রিসিটিতে পরিবর্তিত করে, ইলেক্ট্রিসিটিকে বুস্ট করিয়ে, আবার বুস্ট করা ইলেক্ট্রিসিটিকে আলোতে পরিণত করি তবে অনেক সহজেই আগের চেয়ে উজ্জ্বল আলো পাওয়া সম্ভব, এতে রাতের ক্ষীণ আলোকে উজ্জ্বল করিয়ে, অন্ধকারেও দেখা সম্ভব হবে।

নাইট ভিশন কিভাবে কাজ করে?

নাইট ভিশন চশমা দুইটি প্রযুক্তিতে কাজ করতে পারে—তবে এই প্রযুক্তি দুইটি একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আগেই বলেছিলাম, কোন স্থান অন্ধকার মানে কিন্তু এই নয় যে সেখানে কোন আলোই নেই। সেখানেও আলো (অদৃশ্যমান আলো) থাকে কিন্তু আমরা তা সাধারন চোখে দেখতে পাই না। নাইট ভিশন চশমা ইমেজ ইনহ্যান্সমেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্ধকারে অদৃশ্যমান (যেমন- ইনফ্রারেড লাইট) আলো গুলোকে সংগৃহীত করে, এবং সেই আলোকে বুস্ট করে আলো উজ্জ্বল করে তোলে, যাতে আপনার চোখ তা দেখতে পারে। তবে অনেক সময় অন্ধকার অনেক বেশি হতে পারে, ফলে যথেষ্ট আলো না থাকায় এই প্রযুক্তি কাজ নাও করতে পারে। যেমন ধরুন, আপনি একজন দমকল কর্মী এবং সম্পূর্ণ ধোঁয়াই ঘেরা একটি বিল্ডিং এর মধ্যে কেউ আটকে আছে কিনা তা দেখার চেষ্টা করছেন, এ ক্ষেত্রে ইমেজ ইনহ্যান্সমেন্ট প্রযুক্তির উপর কাজ করা নাইট ভিশন চশমা আপনার চোখের মতোই বেকার।

আরেকটি বিকল্প প্রযুক্তি হলো থার্মাল ইমেজিং, অন্ধকারে অদৃশ্যমান আলোকে খুঁজে বুস্ট করার চাইতে এই প্রযুক্তি অনেক বেশি কার্যকারী। “থার্মাল” শব্দটি শুনেই বোঝা যায়, এই প্রযুক্তি তাপের সাথে জড়িত। প্রত্যেকটি গরম বস্তু, সাথে মানুষের শরীর থেকে কিছু উত্তাপ ইনফ্রারেড লাইট আকারে নির্গত হয়। এখন থার্মাল ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলা নাইট ভিশন চশমা সেই গরম বস্তু হতে নির্গত হওয়া ইনফ্রারেড লাইট ক্যাপচার এবং একটি দৃষ্টিক্ষেত্র তৈরি করে। থার্মাল ইমেজিং প্রযুক্তি তখন ব্যবহার করা হয় যখন অন্ধকারে কোন মানুষকে খোঁজা হয়। যদিও বেশিরভাগ নাইট ভিশন ডিভাইজ ইমেজ ইনহ্যান্সমেন্ট প্রযুক্তির উপর কাজ করে।

নাইট ভিশন চশমায় সবকিছু সবুজ কেন দেখা যায়?

নাইট ভিশন চশমায় সবকিছু সবুজ কেন দেখা যায়?

মুভিতে নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, নাইট ভিশন চশমায় সবকিছু সবুজ স্ক্রিনে দেখা যায়। কিন্তু কেন? আসলে এটি ইচ্ছাকৃতভাবে এমন করা হয়। যখন অন্ধকারে থাকা অদৃশ্যমান আলোকে ক্যাপচার এবং অ্যামপ্লিফাই করানো হয় তখন সকল আলোক রশ্মি গুলোকে ইলেক্ট্রনিক আকারে পরিণত করার প্রয়োজন পড়ে। আর কোন ইলেক্ট্রনিক তথ্যে কালার থাকে না। এখন হয়তো প্রশ্ন করবেন, “তাহলে সাদা-কালো ইমেজ করা হয়না কেন?” নাইট ভিশন চশমা বা নাইট ভিশন ক্যামেরা থেকে আসা পিকচারকে ইচ্ছা করেই সবুজ (গ্রিন স্ক্রীন) করানো হয়—কেনোনা মানুষের চোখ সবুজ রঙের প্রতি বেশি সংবেদনশীল। আপনি সাদা-কালো পিকচারের চাইতেও বেশিক্ষণ সবুজ পিকচারের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবেন।

শেষ কথা

তো আপনি কি অন্ধকারে দেখতে পারেন? হ্যাঁ জানি উত্তর দেবেন, “জী না”। তবে নিশ্চিত হওয়ার দরকার নেই, কেনোনা আজ আপনি জানলেন কোন অন্ধকারই আসলে সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়না, সেখানেও সামান্য আলো থাকে। আর সেই সামান্য আলো থেকে আমরা কিভাবে স্পষ্ট দেখতে পেতে পারি তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও আপনার এখন জানা।

আশা করছি খুব ভালো লেগেছে আজকের টিউনটি, তবে আপনার ভালো লাগার মতামত জানাতে নিচে টিউমেন্ট করতে একদমই ভুলবেন না কিন্তু! তাছাড়া আপনি যেকোনো টেক বিষয় নিয়ে নিচে আমাকে টিউমেন্ট করতে পারেন, আবার আপনার কোন তথ্য জানা থাকলে শেয়ারও করতে পারেন। আমি প্রত্যেকটি টিউমেন্টের রিপ্লাই করি।

পূর্বে প্রকাশিত- Techubs.Net

Level 6

আমি তাহমিদ বোরহান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 10 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 177 টি টিউন ও 680 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 43 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।

আমি তাহমিদ বোরহান। টেক নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকতে ভালোবাসি। টেকটিউন্স সহ নিজের কিছু টেক ব্লগ লিখি। TecHubs ব্লগ এবং TecHubs TV ইউটিউব চ্যানেল হলো আমার প্যাশন, তাই এখানে কিছু অসাধারণ করারই চেষ্টা করি!


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

আপনার টিউন মানেই ভালো কিছু।আগে টিটি সানিম মাহবির ফাহাদ ভাই কাপাইছে এখন আপনে কাঁপাচ্ছেন। আপনাদের মতন টিউনারদের জন্যই এখানে আসা

দারুন

ধন্যবাদ 🙂

eta ki amader deshe pawya njay

BD Army te Ase

Vai personal use er jonno kinte pawa jay ki?