সুপ্রিয় টেকটিউনস কমিউনিটি, সবাইকে আমার আন্তরিক সালাম এবং শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করছি আধুনিক বিশ্বের অন্যতম চালিকাশক্তি ব্যাটারীর ইতিকথা, কার্যপ্রণালী এবং ব্যাটারী নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণ সমূহ নিয়ে আজকের মেগাটিউন।
➡ বর্তমান সময়ে অধিকাংশ ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের প্রধান চালিকাশক্তি ব্যাটারীর সাথে নিশ্চয় আপনারা সবাই পরিচিত। ছোটবেলায় ব্যাটারী বলতে কেবল টর্চ লাইট, রেডিও কিংবা টেলিভিশনের ঢাউস ব্যাটারীকে চিনতাম। ব্যাটারী কথাটি শুনা মাত্র এই দুই ধরনের ব্যাটারীর চিত্রই আমার চোখে ভাসতো। এর মধ্যে ড্রাইসেলগুলোর সাথে আমাদের সখ্যতা ভালো থাকলেও বড় বড় ব্যাটারীগুলোকে আমরা একটু বেশিই সমীহ করে চলতাম। কারন সেগুলো থাকতো এসিড ভর্তি আর যেকোন মূহুর্তে সেগুলোর কারনে মারাত্বক দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো। এই বাংলাদেশে কতো মেয়েকে ব্যাটারীর এসিড দ্বারা ঝলসে দেওয়া হয়েছে তার হিসাব নেই। যাহোক, সময় বদলে গেছে। বদলে গেছে ব্যাটারী বিষয়ে আমাদের ভীতি। তৈরী হয়েছে ব্যাটারী কেন্দ্রিক যন্ত্র সভ্যতার নতুন মাত্রা। আমরা এখন ব্যাটারী বিষয়ে অনেক বেশি কিছু জানি। ব্যাটারীর ইতিহাস বলতে আমরা বড় ব্যাটারী আর ছোট ব্যাটারী বুঝি না। তবে সব কিছু সত্ত্বেও আমাদের কিছুনা কিছু অজ্ঞতা এখনো রয়েছে। তাই সেই অজ্ঞতার অন্ধকারকে বিশুদ্ধ জ্ঞানের আলোয় একটু আলোকিত করার প্রত্যয়ে আমার আজকের টিউনের অবতারনা। আজকের টিউন শেষে আমরা জানবো ব্যাটারী কী, ব্যাটারীর ইতিহাস, কীভাবে কাজ করে এবং যে কারনগুলোর জন্য ব্যাটারীর কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তো চলুন তাহলে শুরু করা যাক।
বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা ১৮০০ সালে সর্বপ্রথম কার্যকরী ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক (তড়িৎচৌম্বকীয়) ব্যাটারী উদ্ভাবন করেন। তিনি খুব উদ্ভট একটা ব্যাটারী আবিষ্কার করেন। যেখানে কপার (তামা) এবং জিংকের (দস্তা) কিছু প্লেট একটার উপরে আরেকটা স্তুপিকৃত করে রাখা হয়। তারপর ভিন্ন ধাতুর সেই প্লেটগুলোকে ব্রাইন (সোডিয়াম ক্লোরাইডের সম্পৃক্ত জলীয় দ্রবণ) সিক্ত পেপার ডিস্ক দ্বারা পৃথক করে রাখা হয়। খুব আশ্চর্যজনক ভাবে এখান থেকেই সর্বপ্রথম ভোল্টেজ উৎপন্ন হয়। এই কপার ও জিংকের স্তুপকেই (Pile) তখন নামকরণ করা হয় ভোল্টেইক পাইল (Voltaic Pile) হিসাবে। যেটি এখনো পর্যন্ত ব্যাটারীর আদিম রূপ হিসাবে বিজ্ঞান মনষ্ক ব্যক্তিদের হৃদয়ে স্থান করে আছে। তার মানে আজ আমাদের এই ব্যাটারী জগত ভোল্টেইক পাইল এরই অত্যাধুনিক রূপ।
১৮৩৬ সালে বিজ্ঞানী ফ্রিডরিক ডেনিয়েল ব্যাটারীর ডিজাইনকে আরও একটু স্ট্যান্ডার্ডাইজ করেন। তিনি দুটি পাত্রের একটাতে কপার সালফেট দ্রবণ এবং অপর পাত্রে জিংক সালফেট দ্রবণ নেন। তারপর কপার সালফেট দ্রবণে কপার ইলেক্ট্রোড (তড়িৎদ্বার) এবং জিংক সালফেট দ্রবণে জিংক ইলেক্ট্রোড স্থাপন করে তাদেরকে একটা তার দ্বারা সংযুক্ত করেন এবং লক্ষ্য করেন যে সেখান থেকে অবিশ্বাস্যভাবে তড়িৎ প্রবাহ পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে অনেক বড় আকারের তড়িৎকোষগুলো মূলত এই ডেনিয়েল সেল। বিজ্ঞানীর নাম অনুসারেই যার নামকরণ করা হয়েছে।
ব্যাটারী আবিষ্কারের প্রায় পৌণে দুইশত বছর পরে অর্থাৎ ১৯৭৯ সালে ব্যাটারী ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। কারন এই সালেই প্রথম রিচার্জেবল ব্যটারী তৈরী হয়। এর আগে যে ব্যাটারীগুলো তৈরী হতো সেগুলো একবারের বেশি ব্যবহার করা যেতো না। কিন্তু অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন কৃতি বিজ্ঞানী John Goodenough এবং Koichi Mizushima লিথিয়াম কোবাল্ট অক্সাইড (পজিটিভ) এবং লিথিয়াম ধাতু (নেগেটিভ) দিয়ে ৪ ভোল্ট রেঞ্জের একটি রিচার্জেবল ব্যাটারী তৈরী করেন। এরপর বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ১৯৯১ সালে বানিজ্যিকভাবে Sony এবং Asahi Kasei কোম্পানি এই বহনযোগ্য ব্যাটারীকে সর্বসাধারনের ব্যবহারের জন্য উন্মোক্ত করে দেয়।
ব্যাটারী হলো এমন একটি তড়িৎ রাসায়নিক কোষ যেটা তার ভেতরে রাসায়নিক কার্যবলীকে তড়িৎ শক্তিতে পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান সময়ে আধুনিক পোর্টেবল ডিভাইসগুলোতে শক্তি সরবরাহ করে থাকে। ব্যাটারীকে অনেক ভাবে শ্রেণীবিন্যস্ত করা গেলেও মূলত আমাদের পরিচত সিস্টেমে আমরা এটাকে দুইভাবে আলাদা করি। তাদের একটা হলো সিঙ্গল ইউজেবল ব্যটারী (যেটাকে একবার ব্যবহার করা যায়) আর একটা হলো রিচার্জেবল ব্যাটারী (যাকে বারবার চার্জ করে পূণব্যবহার করা যায়)।
আধুনিক বিশ্বে অধিকাংশ ব্যাটারীগুলো লিথিয়াম ভিত্তিক ব্যাটারী যেগুলো বারবার চার্জ করার মাধ্যমে পূণ পূণ ব্যবহার করা যায়। এক্ষেত্রে অবশ্য লিথিয়াম পলিমার ব্যাটারীও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর দাম একটু বেশি হলেও এনার্জি একটু কমই পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো লিথিয়াম আয়ন (Li-ion) ব্যাটারীগুলোতে ওভার হিটিং এবং ওভার ইউজ সেন্সর লাগানো থাকে। যেটা ব্যাটারীকে ওভার চার্জ এবং অন্যন্ন ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
আমি আগেই বলেছি লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীগুলো পোর্টেবল ডিভাইসের জন্য ব্যাপক জনপ্রিয়। কারন এতে রয়েছে রিচার্জেবল কোয়ালিটি এবং অনেক বেশি এনার্জি ডেনসিটি। একটি লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারী প্রায় ৩.৭ ভোল্ট বিদ্যুৎ তৈরী করতে সক্ষম যেখানে একটি সাধারন ব্যাটারী সর্বোচ্চ ১.৫ ভোল্ট তড়িৎ সর্বাবরাহ করে। যখন একটি লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীকে চার্জ করা হয় তখন লিথিয়াম আয়নগুলো লিথিয়াম কোবাল্ট অক্সাইড ইলেক্ট্রোড থেকে ইলেক্ট্রোলাইট (যে দ্রবণ তড়িৎ পরিবহন করে) দ্বারা পরিবাহীত হয়ে গ্রাফাইট ইলেক্ট্রোডে পৌছায়। যখন ডিসচার্জ (ব্যবহার) করা হয় তখন শুধু চার্জ এর প্রবাহটা বিপরীতমুখী হয়ে যায়।
লিথিয়াম বেইজড ব্যাটারীগুলো কিন্তু ব্যাটারী-প্যাক হিসাবেও বাজারজাত করা হয়। যেমন ল্যাপটপের ব্যাটারীগুলো হলো ব্যাটারী-প্যাক। ব্যাটারী-প্যাক হলো অনেকগুলো লিথিয়াম ব্যাটারীর একটি সমন্বিত রূপ। যেখানে একের অধিক ব্যাটারী পাশাপাশি সাজিয়ে একটি বড় ব্যাটারী তৈরী করা হয়। তাছাড়া এরকম বড় ব্যাটারী-প্যাক তৈরী করা হলে সেটা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। তাই সেখানে কিছু যন্ত্রাংশ অতিরিক্ত সংযোজন করা হয়ে থাকে। সেই যন্ত্রাংশগুলো সম্পর্কে একটু ধারনা নেওয়া যাক।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীগুলো দীর্ঘদিন পর্যন্ত সচল থাকতে পারে অর্থাৎ দীর্ঘদিন পর্যন্ত চার্জ/ডিসচার্জ চক্র চালাতে পারে। এগুলো এতো সহজেই নষ্ট হয় না। কিন্তু কিছু কিছু কারনে ব্যাটারী খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। চলুন তাহলে সেই কারনগুলো সম্পর্কে এখন জেনে নেই।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীগুলো যেমন উপকারী তেমনি এটারও অপকারীতাও ব্যাপক। ব্যাটারীর মূল উপাদান লিথিয়াম কোবাল্ট অক্সাইড খুব দাহ্য পদার্থ। যদি কোন কারনে ব্যাটারী খুব বেশি উত্তপ্ত হয় তাহলে এটা যেকোন মূহুর্তে আপনার পোর্টেবল ডিভাইস সহযোগে বিস্ফারিত করতে পারে। এ কারনে ব্যাটারীকে নিরাপদ রাখার জন্য ব্যাটারী কী কী কারনে দ্বারা নষ্ট হয়ে যায় সেগুলো জানতে হবে। ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো জানলেই কেবল সুরক্ষিত থাকা যাবে। যাহোক, চলুন জেনে নেই কী কী কারনে ব্যাটারী নষ্ট হয়ে যায়।
ব্যাটারী সম্পর্কিত আলোচনাটা এখানেই শেষ করতে হচ্ছে। তবে এর আগেও আমি ব্যাটারি চার্জিং সম্পর্কিত ভুল ধারনাগুলো নিয়ে একটি টিউন করেছিলাম। সেখানে আমি দেখিয়েছিলাম ব্যাটারী চার্জিং সম্পর্কিত আমরা কী কী ভুল ধারনা পোষন করি। আমার আজকের টিউন এবং সেই টিউনটি যদি আপনাদের সংগ্রহে থাকে তাহলে ব্যাটারী, ব্যাটারী নিরাপদ রাখার উপায় এবং সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে অতিরিক্ত আর কিছু ভাবতে হবে না। তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে টিউনটি দেখে নিন এবং সারা জীবন ভুল ধারনামুক্ত জীবন যাপন করুন।
সঠিক উত্তরদাতাতের মধ্য থেকে একজনকে বিজয়ী ঘোষনা করা হবে এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি সহ তার নাম ঘোষনা করা হবে আমার আগামী টিউনে। সব সময় নতুন কিছু জানতে থাকুন, শিখতে থাকুন এবং নিজেকে নতুন করে গড়তে থাকুন। তবে নকল হইতে সাবধান 👿
টিউনটি যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে অথবা বুঝতে যদি কোন রকম সমস্যা হয় তাহলে আমাকে টিউমেন্টের মাধ্যমে জানাতে ভুলবেন না। কারন আপনাদের যেকোন মতামত আমাকে সংশোধিত হতে এবং আরো ভালো মানের টিউন করতে উৎসাহিত করবে। আর টিউনটিকে মৌলিক মনে হলে এবং নির্বাচিত টিউন হওয়ার উপযুক্ত মনে হলে নির্বাচিত টিউন মনোনয়ন দিতে ভুলে যাবে না যেন। সর্বশেষ যে কথাটি বলবো, আসুন আমরা কপি পেস্ট করা বর্জন করি এবং অপরকেও কপি পেস্ট টিউন করতে নিরুৎসাহিত করি। সবার সর্বাঙ্গিন মঙ্গল কামনা করে আজ এখানেই শেষ করছি। দেখা হবে আগামী টিউনে।
আপনাদের জন্য » সানিম মাহবীর ফাহাদ
➡ ইমেইলে আমার সকল টিউনের আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুনঃ টেকটিউনস » সানিম মাহবীর ফাহাদ 🙄
আমি সানিম মাহবীর ফাহাদ। সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 12 বছর যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 176 টি টিউন ও 3500 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 159 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
আগে যা শিখেছিলাম এখন তা শেখানোর কাজ করছি। পেশায় একজন শিক্ষক, তবে মনে প্রাণে টেকনোলজির ছাত্র। সবার দোয়া প্রত্যাশি।
১.সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত ব্যাটারির নাম ভোল্টেইক পাইল (Voltaic Pile) এবং এটি তৈরী করেন বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা ।
২. রিচার্জেবল ব্যটারিকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন কৃতি বিজ্ঞানী John Goodenough এবং Koichi Mizushima ১৯৭৯ সালে তৈরী করেন
৩.সোডিয়াম ক্লোরাইডের গাঢ় জলীয় দ্রবনকেই ব্রাইন এবং যে দ্রবণ তড়িৎ
পরিবহন করে তাকেই ইলেক্ট্রোলাইট বলা হয়।
৪.লিথিয়াম আয়ণ ভিত্তিক ব্যাটারীর ভোল্টেজ ৩.৭।
৫.ডেনিয়েল সেলে নেভেটিভ তড়িৎদ্বারের নাম কপার ইলেক্ট্রোড।
ভাইয়া আপনার টিউনগুলা অসাধারন। আপনার টিউনগুলোর তুলনা হয় না। আমার খুব ভালো লাগে আপনার টিউনগুলো। ধন্যবাদ আবার ও অনেককিছু শিখতে পারলাম আপনার টিউন থেকে।অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ