সবাইকে সালাম ও শুভেচ্ছা জানিয়ে টেকটিউনস্ এ আমার প্রথম টিউনটি শুরু করছি।ভুলভ্রান্তির জন্য আগেই সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।ভবিষ্যতে আরো ভাল টিউন যেন করতে পারি সেজন্য সকলের শুভকামনা আশা করছি।
১ম পর্ব আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে বলেছেন, "হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।" হযরত আলী(আঃ) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, "নিজেকে, পরিবারকে ও সন্তান-সন্ততিকে উত্তম জ্ঞান শিক্ষা দাও এবং তাদেরকে প্রশিক্ষণ দাও-যাতে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পেতে পারো।" সত্যি-সত্যিই বর্তমান বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রশিক্ষণের জগতে যে বিষয়টি বেশ আলোচিত তা হলো মানব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। মানব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী হলো-ব্যক্তিত্বের যথাযথ বিকাশের মাধ্যমে ইনসানে কামেল বা পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত করা। তাই জন্ম পরবর্তী সময়তো বটেই, এমনকি জন্মপূর্বকালেও ইসলাম বিভিন্নভাবে এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। জন্ম-পূর্ববর্তীকালের প্রশিক্ষণটি হলো একটি সুশৃঙ্খল পরিবার গড়ে তোলা। আর জন্ম-পরবর্তীকালে নবজাতকের প্রশিক্ষণের ব্যাপারেও ইসলাম দিয়েছে চমৎকার কালজয়ী দিক-নির্দেশনা। জন্ম পরবর্তী একটি সন্তানের জীবনকালকে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন শিশুকাল, কিশোরকাল, যৌবনকাল, মধ্যবয়স বা বয়োপ্রাপ্তকাল এবং বার্ধক্যকাল। আমরা এখানে প্রথম তিনটি পর্যায় নিয়ে আলোচনা করবো। রাসূলে কারীম(সাঃ) মানব সন্তানের বেড়ে ওঠার প্রাথমিক কালগুলোকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বে ভাগ করে বলেছেন, "সন্তান তার প্রথম সাত বছরে হলো সাইয়্যেদ বা মহোদয়, দ্বিতীয় সাত বছরে হলো আনুগত্যকারী বা আদেশ মান্যকারী আর তৃতীয় সাত বছরে হলো মন্ত্রী বা দায়িত্বশীল। কী সুন্দর উপমা দিয়ে, পরিভাষা দিয়ে রাসূল শিশুর বেড়ে ওঠার কাল এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্যগুলোকে তুলে ধরেছেন। আমরা তাঁর এই পরিভাষাগুলোকে খানিকটা ব্যাখ্যা করে বলার চেষ্টা করবো। একুশ বছর বয়স পর্যন্ত একটি সন্তানের বেড়ে ওঠার পর্বগুলোকে রাসূল (সাঃ) যেভাবে নির্দেশ করেছেন, তাকে শিশুকাল, কিশোরকাল এবং যৌবনকালের বৃত্তে ফেলা যেতে পারে। শিশুকালটিকে যদি আমরা কর্তৃত্বের অর্থে ধরে নিই, যেমনটি রাসূল বলেছেন, তাহলে তার অর্থ দাঁড়াবে, শিশু এ সময় যা খুশি তা-ই করবে। এ সাত বছর শিশু সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার সকল কর্তৃত্ব মেনে নিতে হবে। এভাবেই শিশু সাত বছর কাটিয়ে দ্বিতীয় সাতে গিয়ে পড়বে। দ্বিতীয় সাত মানে হলো আনুগত্য বা আদেশ পালন করার পর্ব। অর্থাৎ এই পর্বে শিশুকে আর স্বাধীনভাবে কর্তৃত্ব করতে দেয়া যাবে না। বরং তাকেই বাবা-মা বা অন্যান্য মুরুব্বীদের কথা মেনে চলতে হবে। এই দ্বিতীয় সাত অর্থাৎ সাত বছর থেকে চৌদ্দ বছর পর্যন্ত সময়কাল যদি একটি শিশু যথাযথ নির্দেশনা মেনে বেড়ে ওঠে, তাহলে তৃতীয় সাত বছর অর্থাৎ চৌদ্দ থেকে একুশ বছর বয়সকাল পর্যন্ত শিশুটি হয়ে উঠতে পারে সংসার পরিচালনায় বাবা-মায়ের একজন যথার্থ সহযোগী। রাসূল(সাঃ)এর আরেকটি হাদীসে এ পর্ব তিনটিতে সন্তানদের প্রশিক্ষণ এবং বাবা-মায়ের করণীয় আরো পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন, তোমাদের সন্তানদেরকে সাত বছর পর্যন্ত খেলাধূলা করতে দাও, পরবর্তী সাত বছর তাদেরকে সংশোধনীমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দাও এবং পরবর্তী সাত বছর তাদেরকে তোমাদের পরামর্শদাতা ও সহযাত্রী কর। জীবনের প্রথম সাতটি বছরে একটি শিশুর অনুধাবনশক্তি কিংবা স্মৃতিশক্তি থাকে একেবারেই অপক্ক। তার শারীরিক অবস্থাও থাকে অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে। তাই এ সময়টায় বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল আচরণ করা। তার চাহিদাগুলোকে সাধ্যমতো পূরণ করা এবং তাঁর জিজ্ঞাসাগুলোর ইতিবাচক জবাব দেয়া। শিশু তার প্রথম সাত বছর পর্যন্ত স্বাধীন। তাই স্বাধীনভাবে সে খেলাধূলা করবে, নাচানাচি-দৌড়াদৌড়ি করবে, আদেশের পর আদেশ দেবে-যা খুশি তাই করবে। এসবের মাধ্যমে তার মধ্যে ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠবে। তাই তার ওপর এ সময় কোন নিষেধাজ্ঞা বা সীমাবদ্ধতা আরোপ করা অনুচিত। এমনকি তাকে এসময় কোন কিছু সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়াও ঠিক নয়। শিশু তার বাবা-মা তথা পরিবারের সকল মুরব্বী, পাড়া-প্রতিবেশী, আশে-পাশের লোকজন এবং অন্যান্য শিশুদের প্রভাবেই বড়ো হয়ে উঠবে। নিঃসন্দেহে, জীবনের প্রাথমিক পর্বের বছরগুলোই যে-কোন মানুষের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাব সৃষ্টিকারী। কারণ এ সময়টাই মানুষের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার সময়। অতীতে মনে করা হতো যে, শৈশবে একটি শিশুর শারীরিক সুস্থতার প্রতিই কেবল মনযোগী হওয়া দরকার। এর বাইরে শিশুর আবেগ-অনুভূতি, সামাজিকতা, এবং তার মেধাকে প্রতিপালনের ক্ষেত্রে কোন গুরুত্বই দেয়া হতো না। তাদের চিন্তা ছিল এমন যে, শিশু যদি অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে টানাপোড়েনে না ভোগে, তাহলে তার শারীরিক, মানসিক এবং মেধার বিকাশ অন্যদের তুলনায় দ্রুত লাভ হবে। কিন্তু আধুনিককালে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে, শিশুর বেড়ে ওঠার সকল পর্যায়েই শুধুমাত্র শারীরিক বিকাশ নয় বরং তার আবেগ-অনুভূতি, বোধ-উপলদ্ধি, তার কল্পনা-স্মরণশক্তি এবং সেই সাথে শিশুর কথা বলার দক্ষতার ব্যাপারেও সচেতন দৃষ্টি রাখা অনিবার্য। শিশুদের বেড়ে ওঠার সময় তাদের শারীরিক এবং আচার-আচরণে যেসব অসংলগ্নতা দেখা দেয়, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তা ঘটে থাকে শিশুর বেড়ে ওঠার পর্যায়গুলো সম্পর্কে যথার্থ ধারণার অভাবে এবং পর্যায়ক্রমিক সঠিক ব্যবস্থা ও পদপে গ্রহণ না করার কারণেই। যৌবনে পৌঁছে মানুষ সন্ত্রাসী-মাস্তানী, রাহাজানীসহ যেসব অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যকলাপ করে থাকে, গবেষণায় দেখা গেছে জীবনের প্রাথমিক পর্যায়গুলোতে যথার্থ নার্সিং এর অভাবই এ ধরণের ক্রিয়াকলাপের মূল কারণ। তাই শিশুর প্রতিপালনে বাবা-মায়ের সচেতনতা খুবই জরুরী। রাসূল(সাঃ) যে সূক্ষ্ম দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, আমরা তা ধীরে ধীরে বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করবো-শিশুর বেড়ে ওঠার পর্যায়গুলোতে তার যথার্থ যত্ম নিতে হবে কীভাবে। বলাবাহুল্য: রাসূলের নির্দেশনা যে অকাট্য, তাঁর পরিচর্যারীতি যে বিজ্ঞানোত্তীর্ণ, তা জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত আধুনিক এ বিশ্বের গবেষকরাও প্রমাণ করতে সম হয়েছেন। তাই আমরা রাসূলের নির্দেশনাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেবো। ২য় পর্ব ভোরের নরম আলোর মতো শিশুর গালে সুপ্রভাতের প্রথম আদরটি দিয়ে, বিকশমান ফুলের মতো অনাবিল হাসিটি দেখতে কার না ভালো লাগে বলুন: কিন্তু শিশুর এই নির্মল হাসিটিকে তার প্রাপ্ত বয়স পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে পিতামাতার অনেক করণীয় রয়েছে। বিশেষ করে জীবনের প্রথম সাত বছরের পর্বটি হলো তার মানস বিকাশের সময়। নবীন কিশলয় অর্থাৎ গাছের সুগন্ধিময় নতুন পাতার মতো বয়স তার, নবীন পাতাটির মতোই সে নাজুক এবং স্বচ্ছ। অন্যভাবে বলা যায়, জীবনের প্রথম পর্বটি কাঁচা মাটির মতো। এ মাটি দিয়ে বাবা-মায়ের মতো জীবনশিল্পীরা যা গড়তে চান, তা-ই পারবেন। এ কথা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, বাবা-মা কে শিল্পী হতে হবে, জীবন গড়ার শিল্পী। আর শিল্পী হতে হলে জানতে হবে শিল্পের কলা-কৌশল। এর আগের আলোচনায় এইসব কৌশলগত জ্ঞান নিয়ে খনিকটা আলোচনা করা হয়েছে। এবারও তা অব্যাহত রাখবো। রাসূল(সাঃ) একটি সন্তানের জীবনকে তিনটি ‘সপ্তবর্ষে' ভাগ করেছেন। প্রথম সাত বছরকে শিশুর স্বাধীনতার কাল বলে ঘোষণা করেছেন। এই স্বাধীনতার সময়ে শিশুর সাথে কী ধরণের আচরণ করা উচিত-সে সম্পর্কেই আমরা আলোচনা করছিলাম। প্রথম সাথ বছর একটি শিশুর মেধা যেহেতু পর্যাপ্ত পরিমাণ বিকাশ লাভ করে না, সেহেতু এ বয়সের একটি শিশুর মেধা নিয়ে বিশ্লেষণ না করে বরং তার পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি এবং প্রতিক্রিয়ার প্রতিই মনযোগী হওয়া উচিত। অনুভূতিগত দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে যে, শিশুরা পঞ্চ-ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কাজে এ সময় ব্যাপক তৎপর হয়ে ওঠে। সে দৌড়াতে পছন্দ করে, খেলাধুলা পছন্দ করে ,কোন বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়লে প্রশ্ন করতে পছন্দ করে, সর্বোপরি নতুন নতুন বিষয়কে তার অভিজ্ঞতার ভান্ডারে জমাতে পছন্দ করে। আর এ কারণেই সে তার চারপাশে যা কিছুই দেখে, তা-ই ধরতে চায় এবং একাকী নিজস্ব অনুভূতি দিয়ে তাকে বুঝতে চায়, শিখতে চায়, অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চায়। শিশুর স্বাধীনতা মানে তার অনুভূতির স্বাধীনতা, তার মাংসপেশীর স্বাধীনতা। এ দুয়ের যথেচ্ছা ব্যবহারের ফলে শিশুর চলাফেরা তার সৃজনশীলতা এবং তার ইন্দ্রিয়ের বিকাশের ভিত্তিভূমি রচিত হয়। তাই শিশুর প্রথম সাত বছরে তার সাথে এমন কোন কাজ করা উচিত নয়, যাতে তার স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয় এবং পরিণামে তার ইন্দ্রিয় ও সৃষ্টিশীলতা বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, শিশুর মানসিক তথা সৃজনশীলতার বিকাশ যদি বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে শিশুর মনোবিকার ঘটতে পারে। আর তা যদি একবার ঘটেই যায়, তাহলে তার ভবিষ্যত হবে বাবা-মায়ের একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তাই বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। শিশু যখন তার সঙ্গী-সাথী এবং খেলার সাথিদের সাথে আমোদ-প্রমোদ বা খেলাধূলায় ব্যস্ত থাকে, তখন তাকে কোন ব্যাপারে আদেশ দেয়া উচিত নয়। এমনও বলা উচিত নয়-এটা করো না, ওটা করো না.. ইত্যাদি। তাকে তার আনন্দের ভূবন থেকে হুট করে ফিরিয়ে নেয়াটাও ঠিক নয়। তবে হ্যাঁ, যেসব পিতামাতা আপন সন্তানের প্রশিক্ষণের জন্যে সময় দেয়, তারাই সন্তান প্রতিপালনে সফল। একই ভাবে যেসব দেশ শিশুদের খেলাধূলা, আমোদ-প্রমোদ বা বিনোদনের জন্যে প্রয়োজনীয় ও যথোপযুক্ত জিনিসপত্র সরবরাহ করতে সম, সেসব দেশই মূলত উন্নয়নশীল বা উন্নত দেশ হিসেবে পরিগণিত। শিশু যদি তার বেড়ে ওঠার জন্যে একটা মুক্ত পরিবেশ পায় এবং যথার্থ শক্তি বা এ্যানার্জি লাভের জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ ও গাইড লাইন পায়, তাহলে তার মানসিক, শারীরিক এবং আচার-আচরণগত বিকাশ বিজ্ঞানসম্মতভাবেই অর্জিত হবে। বাবা-মায়ের এই বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগী হওয়া বাঞ্চনীয়। আগেই বলেছি যে, শিশুদেরকে মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া উচিত। তাদের এই স্বাধীনতায় সামান্যতম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হলেও শিশুদের আত্মিক, মনস্তাত্ত্বিক ও আচার-আচরণগত ভারসাম্য লঙ্ঘিত হয়। স্কুলে অধিকাংশ শিশুর মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাই তাদের পারিবারিক পরিবেশের পরিণতি। অর্থাৎ সন্তান প্রতিপালনে বাবা-মায়ের যথাযথ ব্যবস্থা বা গাইডেন্সের অভাবেই ঐসব সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। নবজাতকের সাথে বাবা-মায়ের সংবেদনশীল আচরণ করা উচিত। অর্থাৎ সন্তানের আরাম-আয়েশ এবং স্বাধীনতার বিষয়টি অনুভব করা উচিত। অত্যন্ত যতেœর সাথে শিশুকে ঘুম পাড়ানো উচিত। ঘুম থেকে জাগার সময় শিশুর প্রতি রুষ্ট হওয়া ঠিক নয়। শিশুকে আদরের সাথে দুধ খাওয়ানো, তার নষ্ট করে দেয়া জামা-কাপড় পরিস্কারের কাজ আন্তরিকতার সাথে আঞ্জাম দেয়া উচিত। এমনকি শিশু যদি কান্নাকাটিও করে, তবুও তার ওপর রেগে যাওয়া ঠিক হবে না বরং কান্নার একটা ইতিবাচক জবাব দিতে হবে। শিশুর বেড়ে ওঠার প্রাথমিক পর্যায়ে বাবা-মা যদি শিশুর সাথে যথাযথ ব্যবহার করে, তাহলে ভবিষ্যতে শিশুর চারিত্রিক বিকাশ, মানস গঠন এবং তার ব্যক্তিত্বের ওপর বাবা-মায়ের ব্যবহার ও প্রতিক্রিয়ার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর যথার্থ ব্যবহার করা না হলে তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়বে শিশুর ভবিষ্যত জীবনের ওপর। শিশুর জীবন বিকাশের প্রাথমিক পর্বে তার শরীর-মন-আত্মা সব কিছুই অত্যন্ত কোমল ও নরম প্রকৃতির থাকে। তার কোমল মন তাই আদর-যত্ম , স্নেহ-ভালোবাসাই প্রত্যাশা করে। সে খেলতে চায়, দৌড়াদৌড়ি করতে চায়। প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতে চায়। এ সময় তার হাসিতে যেন বংধনু ছড়ায়, পাথরের দিকে তাকালে পাথরও যেন গলে যায়। গাছের দিকে তাকালে যেন ফুল ফোটে, প্রকৃতি যেন তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে ভরিয়ে দেয় তার মন। তাই বাবা-মায়ের মতো তার আশেপাশের সবারই উচিত এমন স্নেহ ও ভালোবাসাপূর্ণ এবং আদরপূর্ণ ব্যবহার করা, যাতে শিশুর মুখে সর্বদা লেগে থাকে অনাবিল হাসি, আর মন পরিপূর্ণ থাকে আদর-আপ্যায়নে। কোনভাবেই তার সাথে এমন আচরণ করা ঠিক নয় যাতে সে মনে কষ্ট পায়। হাদীস অনুযায়ী প্রথম সাত বছর হলো শিশুর স্বাধীনতার পর্যায়, আনুগত্যের পর্যায় নয়। তারপরও কোন কোন বাবা-মা মনে করেন যে, এ সময় শিশুর উচিত বাবা- মায়ের সকল আদেশ-নিষেধ মেনে চলা অর্থাৎ বাবা-মায়ের পূর্ণ আনুগত্য করা। তারা ভাবেন যে, সন্তানের কাজ হলো কথা শোনা, অন্য কোন কাজ করা উচিত নয়। নিজের জায়গা থেকে তাদের নড়া ঠিক নয়, লাফালাফি করা উচিত নয়, বেশী কৌতুহলী দেখানো ঠিক নয়। সন্তান কেবল চুপচাপ বসে থাকবে, প্রতিবেশীকে বিরক্ত করবে না-এই হলো সন্তানের করণীয়। কিন্তু ইসলাম এবং আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে শিশুর স্বাধীনতার পর্যায়ে বাবা-মায়ের এ ধরনের খবরদারী একদম অনুচিত। ৩য় পর্ব শিশুর বেড়ে ওঠার প্রথম পর্ব অর্থাৎ প্রথম সাত বছরে, শিশুর যথাযথ বিকাশের জন্যে বৈজ্ঞানিক ও রাসূল(সাঃ) নির্দেশিত প্রতিপালন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছি। শিশুর জীবনের প্রথম সাত বছর হলো, স্বাধীনতার চর্চার কাল। এ সময়টা শিশুর সুপ্ত প্রতিভার উন্মেষ ও বিকাশ লাভ করে। এ সময়টাতে তাই বাবা-মায়ের সচেতনতা খুবই জরুরী। এ পর্বে আমরা শিশুর প্রতিভার উন্মেষকালে পিতা-মাতার করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করব। যে শিশু তার চারপাশের পরিবেশকে মুক্ত-স্বাধীন ও শান্তিময় মনে করে এবং যা চায় তা-ই পায়, সেই শিশুর ব্রেইন বা মেধার উন্মেষ স্বাভাবিক গতিতেই ঘটবে, সেই সাথে সে তার সাধ্যমতো স্বাভাবিক এই মেধার আত্ম-প্রকাশ ঘটাতে চাইবে। কারণ হলো সে তার ব্যক্তিত্ব ও মেধার বিকাশের পথে কোন রকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়নি। ভবিষ্যতেও তার জ্ঞান-বুদ্ধি, মেধা ও সৃষ্টিশীলতায় এই অবাধ পরিবেশের প্রভাব পড়বে। পান্তরে, শিশু যদি তার পরিপার্শ্বকে মুক্ত ও স্বাধীন না পায়, তার শিশুসুলভ চাহিদাগুলো যদি না মেটে, অর্থাৎ তার চাহিদা পূরণের পথে যদি কোন রকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়, তাহলে তার মেধা বিকাশের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এ অবস্থায় শিশুর সুপ্ত প্রতিভাগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তার প্রতিভার উন্মেষ বা বিকাশের আর কোন অবকাশই থাকবে না। এ ধরণের শিশুর ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে পড়ে এবং তারমধ্যে আর কোন সৃষ্টিশীলতাই অবশিষ্ট থাকে না। একটি শিশু তার প্রথম সাত বছর বয়সে ভাবে, বাবা-মায়ের কাছে সে যা চাইবে, তাই পাবে। অর্থাৎ বাবা-মা তার চাহিদাগুলোকে প্রশ্নহীনভাবে বাস্তবায়ন করবে। সেজন্যে এ সময়টায় বাবা-মায়ের প্রতি শিশুর বিশ্বাস থাকে অগাধ। বাবা-মাকে সে তার বন্ধু, সহযোগী এবং তার একান্ত আশ্রয় মনে করে। তাদেরকে সে নিরাপদ মনে করে এবং সেজন্যেই তাদেরকে সে ভীষণ ভালোবাসে। শিশু যখন বড় হয় তখনও সে বাবা-মায়ের ভালোবাসার কথা ভোলে না। বাবা-মা তাকে যে কী পরিমাণ ভালোবাসতো, আদর-যত্ন করত, সে তা উপলদ্ধি করে এবং তাদের ভালোবাসার কাছে যে ঋণী সে তা অনুভব করে। বড়ো হয়ে তাই এই সন্তান বাবা-মায়ের কথা বেশ মনযোগের সাথে শোনে। তাদের দিক-নির্দেশনা, তাদের জীবন অভিজ্ঞতা থেকে সে লাভবান হয়। যে কোন জটিল ও বিরুপ পরিস্থিতিতে বাবা-মাকেই সে আপন ভাবে এবং তাদের সাথে সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা ও পরামর্শ করে। তাদেরকেই নিজের একান্ত পৃষ্ঠপোষক বলে মনে করে। সন্তান যেহেতু বাবা-মায়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করে, সেহেতু বাবা-মায়ের সকল যুক্তি ও পরামর্শ আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করে। তাদের যথাযথ আনুগত্য করে এবং সর্বাবস্থায় তাদের নির্দেশ মেনে চলে। শিশু জীবনের প্রথম পর্বে বাবা-মায়ের আচরণগত ত্রুটিই যুব সমাজের অধিকাংশ সমস্যার জন্য দায়ী। বাবা-মা, সন্তানের আত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাহিদাগুলোর প্রতি কোন রকম মনযোগ না দেয়ার কারণে সন্তান ও বাবা-মায়ের প্রতি আস্থাহীনতায় ভোগে। আর বাবা-মায়ের প্রতি সন্তান যদি আস্থা-বিশ্বাস, নির্ভরতা স্থাপন করতে না পারে, তাহলেই বাবা-মায়ের সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এই দুরত্ব সন্তানকে বিপথগামী করে তোলে। এ আলোচনায় নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন যে, সন্তানের বেড়ে ওঠার প্রাথমিক পর্বে বাবা-মাকে কতোটা সচেতন থাকতে হবে। সন্তানের বিপথগামীতা এবং বাবা-মায়ের সাথে তাদের দূরত্ব সৃষ্টির জন্য কিন্তু তারা নিজেরাই দায়ী। ফলে সন্তানকে ভালবাসতে হবে। তার আত্মিক এবং মনস্তাত্ত্বিক চাহিদাগুলো পূরণের ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। তার বেড়ে ওঠার যথার্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি, শিশুর ভবিষ্যত যে পিতা-মাতার ওপরই নির্ভর করে-তা মনে প্রাণে উপলদ্ধি করতে হবে। আসরের এ পর্যায়ে, শিশুর বিকাশের প্রাথমিক পর্ব অর্থাৎ সাত বছরে বাবা-মায়ের কর্তব্যগুলো সম্পর্কে সংপ্তি আলোচনা করবো। আসলে শিশুদের সমস্যাগুলো বাবা-মায়েরই সৃষ্টি। তাই শিশুর সমস্যা এড়াতে বাবা-মায়ের উচিত- ১) সন্তানের জন্যে একটা সময় নির্দিষ্ট করা। তার সমস্যা, তার জিজ্ঞাসা, তার কৌতূহলের যথাযথ উত্তর দেয়া। ২) তার বেড়ে ওঠার জন্যে যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সন্তানের চাহিদাগুলো পূরণে সচেষ্ট হওয়া। ৩) শিশুর ওপর খবরদারী করা থেকে বিরত থাকা উচিত। এটা করো না, ওটা ধরো না, এটা করো, সেটা ধরো-এসব করা ঠিক নয়। তারচে বরং এসব কথা যাতে বলতে না হয়, সে ব্যাপারে আগেই সচেতন থাকা উচিত। এসব করা হলে শিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। ৪) শিশুর জন্যে যেসব জিনিসপত্র তিকর ও ভয়াবহ, সেসব জিনিস তার হাতের নাগালে রাখা অনুচিত। অন্যথায় শিশু যদি ঐসব জিনিস দিয়ে কোন জরুরী কিছু নষ্ট করে, তাহলে ঐসব জিনিস নষ্ট করার জন্যে শিশুকে কোনভাবেই দোষারোপ করা যাবে না। অর্থাৎ তার ওপর রাগ দেখানো যাবে না। ৫) বাবা-মায়ের উচিত বাসায় তাদের জরুরী জিনিসগুলো যথাযথ জায়গায় রাখা। ছুরি-চাকু বা এ ধরণের ধারালো জিনিসগুলো, বিষাক্ত ঔষধপত্র, কীট নাশক জাতীয় জিনিস, কাঁচের জিনিসপত্র, দামী তৈজসপত্র, জরুরী কাগজপত্র প্রভৃতি শিশুর হাতের নাগালের বাইরে রাখা উচিত। ৬) শিশু যখন জেগে থাকে, তখন এমন কোন জিনিস বের করা বা মেরামত করার জন্যে খোলা ঠিক নয়, যার ছোট্ট একটি যন্ত্রাংশ হারালে বা নষ্ট হলে পুরো জিনিসটাই নষ্ট হয়ে যাবে। অন্যকথায় শিশু এসব যন্ত্রপাতি নষ্ট করলে তার ওপর রেগে যাওয়া ঠিক নয়। কারণ শিশু এ সময়টায় কৌতূহলী হবে-এটাই স্বাভাবিক। তার কৌতূহল থেকে তাকে নিবৃত্ত করা যাবে না। অর্থাৎ এ দিকে এসো না, এটা ধরো না-এরকম বলা যাবে না। পরিবারে যদি স্কুলগামী কোন সন্তান থাকে, তাহলে তার বই-পুস্তকসহ অন্যান্য শিক্ষা-উপকরণ এমনভাবে রাখতে হবে, যাতে শিশু সেগুলো ধরতে না পারে, নষ্ট করতে না পারে। মায়ের যদি সেলাই কাজের অভ্যাস থাকে, তাহলে তা করতে হবে শিশু যখন ঘুমোয় তখন, অথবা এমন কোন জায়গায় যেখানে শিশুর উপস্থিতির সম্ভাবনা নেই। আর সুঁই-সূতা-ব্লেড ইত্যাদি রাখতে হবে নিরাপদ দূরত্বে। ধরা যাক, বহু সতর্কতার পরও শিশু ব্লেড বা ছুরি-চাকু জাতীয় কিছু একটা হাতে নিল। এ অবস্থায় কী করতে হবে? না, কোন অবস্থাতেই চীৎকার চেঁচামেচি করা যাবে না, বরং তার সামনে এমন অন্য একটা জিনিস এনে হাজির করতে হবে, যাতে শিশুর মনযোগ সেদিকে যায় এবং সুযোগমতো ঐ ভয়ানক বস্তুটি তার হাত থেকে সরিয়ে নেয়া যায়। এমন ভাবে নিতে হবে যাতে শিশুটি একদম টের না পায়। বাবা-মায়ের এতো সতর্কতার কারণ হলো, এ সময়টা শিশুর পরিপূর্ণ স্বাধীনতার পর্ব। তার যা খুশী তা-ই করবে সে। তাকে আদেশ দেয়া যাবেনা, বারণও করা যাবে না। শিশুর মেধা বিকাশের স্বার্থে বাবা-মা ভালোবেসে, আদর করে এটুকু ছাড় দেবেন-এটাই প্রত্যাশা। ৪র্থ পর্ব ‘আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে, আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই।' কিংবা ‘এ পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি'-গীতিকার বা কবির এই যে আকুলতা, এই যে প্রতিশ্রুতি, তা শিশুর প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা এবং তার সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করারই প্রয়াসমাত্র। সমস্যা হলো, শিশুর ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ল সবারই আছে। কিন্তু কিভাবে তা গড়তে হবে, সেটা যথার্থভাবে অনেকেরই জানা নেই। তাই এবারের পর্বে আমরা শিশু জীবনের দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ সাত থেকে চৌদ্দ বছর বয়সকালীন তার আচার-আচরণগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো। শিশু জীবনের দ্বিতীয় পর্বটি হলো সাত থেকে চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত। এই বিভাজন রাসূল(সাঃ) নিজেই করে গেছেন। প্রথম সাত বছর হলো শিশুর স্বাধীনতার কাল। আর দ্বিতীয় পর্ব হলো শিশুর আনুগত্যের কাল। এই দ্বিতীয় সাত বছরে শিশুর শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন লংঘনীয় পর্যায়ে যায়। তার শরীর আগের তুলনায় একটু শক্ত-সামর্থ হয়, স্মৃতিশক্তি বিকশিত হয়, তার জ্ঞান-বুদ্ধি-উপলব্ধিও বৃদ্ধি পায়। একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত শিশু ভালো-মন্দও বুঝতে পারে। এ কারণে শিশু তার মুরব্বীদেরকে তার কৌতূহল মেটানোর জন্যে বিভিন্ন প্রশ্ন করে বেড়ায়। তবে তার বুদ্ধির যেহেতু পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি, সেহেতু কীসে তার কল্যাণ, আর কীসে অকল্যাণ-তা যথার্থভাবে বুঝে উঠতে পারে না। আর বুঝতে পারে না বলেই বাবা-মা বা মুরব্বীদের উচিত হলো, এ সময় তাকে বোঝানো, শেখানো। অর্থাৎ তার কোন্টা করা উচিত, আর কোন্টা করা উচিত নয়-সে ব্যাপারে তাকে দিক-নির্দেশনা দেয়া এ মুহূর্তে অভিভাবকদের কর্তব্য। শিশু এ সময় বাবা-মায়ের কথাবর্তা শনুবে, আনুগত্য করবে-এটাই স্বাভাবিক। বাবা-মা এসময় শিশুকে ভদ্রতা-শিষ্টাচার এসব শেখাবে। শিশুকে জ্ঞান দান ও প্রশিক্ষণ দানের উপযুক্ত বয়সই হলো এই দ্বিতীয় সাত বছর। এ পর্বের শুরু থেকেই শিশুর আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের সূচনা ঘটবে। শিশু স্কুলে যেতে শুরু করবে। তার ওপর পাঠ-অনুশীলনসহ সীমিত পর্যায়ের কিছু কিছু দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হবে। শিশু যদি তার জীবনের প্রথম পর্বটি যথার্থ পরিবেশের মধ্যে কাটাতে সম হয়ে থাকে অর্থাৎ যথার্থ স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যদি বেড়ে উঠে থাকে, তাহলে আনুগত্যের পর্বে তার একধরণের মানসিক ভারসাম্য সৃষ্টি হবে। তাই অত্যন্ত আন্তরিকতা ও আনন্দের সাথে সে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব গ্রহণ করবে এবং আরো বেশী জীবনাভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে শিশু তার বাবা-মা বা মুরব্বীদের আনুগত্য করবে। তারা যা বলেন, তা শুনবে। যা আদেশ করেন তা পালন করবে। একটা শিশু যখন তার দ্বিতীয় সপ্তবর্ষে পা দেয়, তখন সে উপলব্ধি করতে পারে যে, অভিভাবকদের তুলনায় জ্ঞান এবং যোগ্যতায় সে অনেক পিছিয়ে আছে। অর্থাৎ বাবা-মা যা জানে, সে তা জানে না। তখনই তার মনে নানা রকম প্রশ্ন জাগে। কিন্তু শিশু যেহেতু তার ক্ষুদ্র জ্ঞানের মাধ্যমে সেসব প্রশ্নের সমাধান করতে পারে না, তাই তার প্রয়োজন পড়ে এমন কাউকে-যে তার প্রশ্নগুলোর জবাব দেবে। শিশু চায়, যে তার কৌতূহলগুলোর জবাব দেবে, সে যেন তার প্রতি পরিপূর্ণ মনযোগী হয়, সে যেন কোন রকম দ্বিধা-সংকোচ ছাড়াই তাকে প্রশ্ন করতে পারে এবং জবাব পেতে পারে। সাত থেকে চৌদ্দ বছর বয়সে একটা শিশুর মেধা, জ্ঞান-বুদ্ধি কিছুটা বৃদ্ধি পায়। ফলে তার চাহিদা, তার প্রত্যাশাও আগের তুলনায় কিছুটা উৎকর্ষ লাভ করে। আগের মতো একেবারে শিশুসুলভ আর থাকে না। তাই এ সময়টায় শিশুকে শিক্ষা দেয়া যায়, প্রশিক্ষণ দেয়া যায়। তাকে আর পুরোপুরি স্বাধীনতা দেয়া যাবে না। বরং তার সকল কর্মসূচী ছকে বেধে দিতে হবে, যেন সে শৃঙ্খলা শিখতে পারে। এ সময় তাকে একটু একটু ইবাদত সম্পর্কে শেখানো যেতে পারে। শিশু জীবনের দ্বিতীয় সপ্তবর্ষে তার মেধা ও স্মৃতিশক্তির বিকাশ ঘটে। তাই এ সময়টাই হলো শিশুকে শেখানোর সময়। বিশেষ করে এই বয়সটাতেই শিশুকে আদব-কায়দা বা শিষ্টাচার এবং ইসলামী আচার-আচরণ পদ্ধতি শেখাতে হবে। স্কুলে শিকদের কাছ থেকে এবং বাসায় বাবা-মায়ের কাছ থেকে এই দ্বিতীয় সাত বছর অর্থাৎ ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সকালে শিশু যেসব শিষ্টাচার শিখবে, তা কিশোর ও যৌবনকালে তার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শিশুর জ্ঞান-বুদ্ধি, স্মৃতিশক্তি, মেধার বিকাশ এবং শেখার গতি এ সময় খুব প্রখর থাকে। প্রাপ্ত বয়সে তার মানবিক বোধ, আবেগ-অনুভূতি, আচার-আচরণগত বৈশিষ্ট্য এই দ্বিতীয় সাত বছরের শিক্ষারই ফলাফল। ইসলামের আচরণ পদ্ধতি ও শিষ্টাচার সম্পর্কে হাদীসে যেসব বর্ণনা বা নির্দেশনা এসেছে, শিকদের উচিত কাসে ছাত্রদের সামনে সেই সব আচরণ পদ্ধতি কৌশলে, গল্পাকারে বা অন্য যেকোন আকর্ষণীয় উপায়ে বর্ণনা করা, যাতে কোমলমতী শিশু-ছাত্ররা সে সব শিখে তাদের স্বভাবগত উৎসাহেই নিজের জীবনে কাজে লাগাতে পারে। দ্বিতীয় সপ্তবর্ষে কোমলমতী ছাত্ররা স্কুলে যেসব গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচার শিখতে পারে বা শিকদের যেটা শেখানো উচিত তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি। শিশুকে শেখানো যেতে পারে কী ভাবে সালাম করতে হবে, কীভাবে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয়, আল্লাহর নামে সকল কাজ শুর করা, খাওয়ার নিয়ম, পানিয় বস্তু গ্রহণ করার নিয়ম, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাবা-মা ও মুরব্বীদের সম্মান করা, অন্যদের সাথে চলাফেরা বা মেলামেশার নিয়ম, কথাবার্তা বলার শালীনতা, ঘুমানোর পদ্ধতি, যেকোন কাজে অপরের অধিকার সংরণ করা। এছাড়া অজু করার নিয়ম, গোসল করার নিয়ম, নামায পড়া এবং দোয়া করার পদ্ধতির সাথে পরিচয় করানো যেতে পারে। তাকে রোযা রাখা, কোরআন পড়া, ভ্রমণে যাবার ক্ষেত্রে করণীয় এবং বন্ধুত্বের নিয়ম-শৃঙ্খলার বিষয়েও জ্ঞান দেয়া যেতে পারে। এই সব শিষ্টাচার বা নিয়ম-শৃঙ্খলা শেখানোর পাশাপাশি চারিত্রিক গুণাবলী ও উত্তম স্বভাব অর্জনের ক্ষেত্রেও শিশুকে দিক-নির্দেশনা দিতে হবে। তাকে সব ধরণের মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখতে হবে, যাতে তার চরিত্রের ওপর ঐসব মন্দ কাজের প্রভাব পড়তে না পারে। এটাও দ্বিতীয় সপ্তবর্ষের একটি শিশুকে প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তাই শিশুকে সুন্দর ও যথার্থভাবে গড়ে তোলার জন্যে প্রথমতঃ নিজেরা প্রশিতি হবেন এবং তারপর শিশুদেরকে প্রশিক্ষণ দেবেন। মনে রাখতে হবে যথার্থ দিক-নির্দেশনার অভাবেই কিন্তু শিশুর ভবিষ্যত হয় বাবা-মায়ের অপ্রত্যাশিত। # ৫ম পর্ব সন্তানের ভবিষ্যৎ সুন্দরভাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে জন্মের পর থেকেই তাকে কীভাবে প্রশিক্ষিত করতে হবে-সেই দিক-নির্দেশনা দেয়াই এ আলোচনার উদ্দেশ্য। অনেক বাবা-মা আছেন যারা সন্তানকে ভালোবাসেন ঠিকই, কিন্তু জানেন না শিশু প্রতিপালনের যথার্থ পদ্ধতি। মুরব্বীদের পরামর্শ অনুযায়ী সন্তানের তত্ত্বাবধান করে থাকেন তারা। কিন্তু সমস্যা হলো মুরব্বীদের পরামর্শ যদি বিজ্ঞান সম্মত হয়, তাহলে তো ভালই আর অবৈজ্ঞানিক বা মনগড়া হয়ে থাকলে তা শিশুর বেড়ে ওঠার স্বাভাবিকতায় বিঘ্ন ঘটাবে। তাই বাবা-মায়ের উচিত, শিশুর জীবন বিকাশের প্রকৃতি সম্পর্কে জানা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা শিশুর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য এবং সে অনুযায়ী বাবা-মায়ের করণীয় সম্পর্কে কথা বলছিলাম। দ্বিতীয় সপ্তবর্ষে শিশুর আচরণগত বৈশিষ্ট্য এবং তাকে কী কী শিষ্টাচার এ বয়সে শেখাতে হবে তা এর আগের পর্বে উল্লেখ করেছিলাম। এবারের পর্বেও সে আলোচনা অব্যাহত রাখবো। সাত থেকে চৌদ্দ বছর বয়সে একটি শিশু স্কুলে যেসব আদব-কায়দা বা শিষ্টাচার শিখবে, সেগুলোকে সাথে সাথেই বাস্তবায়নের পরিবেশ তৈরী করতে হবে। এমনভাবে তাদেরকে শেখাতে হবে, যাতে তারা তাদের বাবা-মা বা অন্যান্য মুরব্বীদের সাথে কথাবার্তা বা আচার-আচরণ করতে গিয়ে সেসব শিক্ষাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজে লাগায়। তাদেরকে যেসব শেখানো হয়, সেগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগ যদি না থাকে, তাহলে ঐসব শিক্ষা কোন কাজেই আসবে না। ফলে শিশুদের ব্যক্তিত্ব গঠনে এই সব শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের কোন প্রভাবই পড়বে না। এ বয়সে শিশুর জীবনে যেসব চারিত্রিক ও নৈতিক গুণ দৃঢ় হওয়া উচিত কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে আচার-আচরণগত ত্রুটির সংশোধন হওয়া উচিত, সেগুলো সম্পর্কে এবার আলোচনা করা যাক। এ বয়সে শিশুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে যে গুণগুলো থাকা উচিত, সেগুলো হলো সততা ও সত্যকথা বলা, মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকা, হিংসা বা ঈর্ষা করা থেকে বিরত থাকা, গীবত বা কারো অনুপস্থিতিতে দোষ বলে বেড়ানোর মতো শয়তানী আচরণ থেকে বিরত থাকা, ভালো কাজ করা এবং অন্যের উপকার করা, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ কিংবা গুজব রটনা থেকে বিরত থাকা, প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা এবং ফালতু কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। এই যে কতগুলো নৈতিকগুণের কথা আমরা উল্লেখ করলাম এগুলো নিরন্তর অনুশীলনের ব্যাপার। বাবা-মা কে অসম্ভব সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে এবং এগুলোর ব্যতিক্রম নজরে পড়লেই তা সংশোধন করার যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। রেগে-মেগে ভয় দেখিয়ে কিছু করা ঠিক হবে না। এ বয়সে শিশুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে আরো কিছু গুণের সমাবেশ ঘটা উচিত। যেমন, অন্যের প্রতি জুলুম বা অত্যাচার করা থেকে বিরত থাকা এবং অন্যদেরকে বিরক্ত করা বা যন্ত্রণা দেওয়া থেকে বিরত থাকা, অপচয় বা অপব্যয়মূলক কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকা, কথা দিয়ে কথা রাখার গুরুত্ব উপলদ্ধি করা, অন্যদের সাথে একগুঁয়েমি বা জেদি মনোভাব পোষণ করা থেকে বিরত থাকা, দান করা, দয়াশীল ও উদার হওয়া, মা ও মহানুভবতা দেখানো, নিজ ও অন্যান্যদের ব্যাপারে যথার্থ বিচারবোধ জাগা, জালিমের শত্রু এবং মজলুমের বন্ধু হওয়া এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণ নিজের মধ্যে জাগ্রত রাখা। এখন কথা হচ্ছে এইসব গুণাবলী কি শিশু প্রাকৃতিকভাবেই অর্জন করবে? না, শিশুকে এসবের ব্যাপারে যথার্থ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যখনি শিশু এইসব গুণাবলীর বিপরীত আচরণ করবে, তখনি বাবা-মায়ের উচিত হবে মনস্তাত্ত্বিক পরিচর্যার মাধ্যমে শিশুকে এমনভাবে সেগুলো সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান দেওয়া যাতে শিশু বিরক্ত না হয় কিংবা বাধ্য না হয়। জোর করে কোন কিছু শেখালে শিশুর মনে বাবা-মা ভীতি কাজ করবে। ফলে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মূল ল্যই ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ধরা যাক বাবা-মা যদি শিশুকে কোন কথা দিয়ে না রাখে, তাহলে শিশুও তা করতে শিখবে। ফলে শিশুকে শেখানোর আগে গুণগুলো বাবা-মায়ের ভেতরে অর্জিত হওয়া প্রয়োজন। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, তাহলো ৭ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত একটি শিশু আনুগত্যের পর্যায় অতিক্রম করে। অর্থাৎ এ সময় বাবা-মা, মুরব্বী, শিক তথা শ্রদ্ধেয়দের কথা মেনে চলাই হলো শিশুর প্রধান কর্তব্য। এটা একটা কঠিন পর্যায়। শিশুর জন্যেও কঠিন, অভিভাবকদের জন্যেও কঠিন। শিশুর জন্যে কঠিন, কারণ সর্বাবস্থায় শিশুর কাজ হলো আনুগত্য করা। আর বাবা-মা বা অভিভাবকদের জন্যে কঠিন, কারণ শিশু এ সময় বাবা-মা বা মুরব্বীদেরকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে। ফলে বাবা-মা, শিক-অভিভাবকদের অবশ্যই আদর্শস্থানীয় হতে হবে। এখন কথা হলো, একটি শিশু যদি কোন মুরব্বী সম্পর্কে কিংবা ধরা যাক তার কোন শিক সম্পর্কে বাবা-মায়ের সামনে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল করে, আর বাবা-মা যদি তা শুনে মজা নেয়, তাহলে পরিণতিটা কী হবে? পরিণতি দাঁড়াবে এই-শিশুটি ঐ শিককে আর শ্রদ্ধা করবে না। ফলে পড়ালেখা থেকে তার মন উঠে যাবে। অন্যদিকে শিক সম্পর্কে কথা বলার অভ্যাস যেহেতু হয়ে গেছে, তাই ধীরে ধীরে অন্যদের ব্যাপারেও কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে পরিণতিতে এই শিশু ভবিষ্যতে বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে যেতে পারে। বাবা-মাকে তাই সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি শিকদেরও উচিত শিশুদের মনস্তত্ত্ব বোঝা এবং নিজেদের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে শিশুদের সাথে আচরণ করা। সর্বোপরি নিজেদের মেধা কাজে লাগিয়ে শিশুদের মন জয় করা। শিশু জীবনের প্রথম সপ্তবর্ষ হলো স্বাধীনতার পর্যায়। সাত-সাতটি বৎসর স্বাধীনতা ভোগ করার পর একটি শিশু আনুগত্যের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। দ্বিতীয় সাত বছর আনুগত্য করার ফলে শিশুর জীবনের এখন কিছুটা দায়িত্ব জ্ঞান, নৈতিকতাবোধ জেগেছে। শিশু যদি যথার্থভাবে তার আনুগত্যের পর্যায় অতিক্রম করে থাকে, তাহলে শিশুটি এখন এমন কিছু মেধা ও জ্ঞান-বুদ্ধি অর্জন করতে সম হয়েছে যা দিয়ে সে তার মুরব্বীদেরকে কাজে-কর্মে সহযোগিতা করতে পারে । এভাবেই শিশুটি তার জীবনের তৃতীয় সপ্তবর্ষে এসে পৌঁছুবে । এ পর্যায়টি শিশুর দায়িত্বশীলতার পর্যায়, বাবা-মা বা পরিবারকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করার পর্যায় । ফ্রান্সের একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব মৌরীস রব্সের একটি উক্তির মধ্য দিয়ে এ পর্বের আলোচনা শেষ করবো। তিনি বলেছেন প্রতিটি ঘরের দরোজা হয়ে উঠুক শিক উন্মুখ, আর প্রতিটি বিদ্যালয়ের দরজা পরিবারের জন্য উন্মুক্ত হয়ে থাকুক। আমরা চাই এককভাবে কোন স্কুল বা কোন পরিবার যেন একটি শিশুর পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ না করে। অর্থাৎ গৃহ এবং স্কুল পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠুক। এ উক্তির ব্যাখ্যা এভাবেও করা যেতে পারে যে, শিশুকে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েই বাবা-মা যেন এরকম মনে না করেন যে তাদের দায়িত্ব শেষ। আবার বাসায় শিশুকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েই যেন কেউ এরকম না ভাবেন যে তাকে আর স্কুলে পাঠানোর দরকার নেই। আমরা এসব ব্যাপারে যৌক্তিক হব, সচেতন হব-এ কামনা করছি। ৬ষ্ঠ পর্ব আজ যে শিশু, আগামী দিনে সেই হবে শিশুর পিতা, সেই জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে উন্নতির দিকে । "ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে" কবিতার এই লাইনটি নিশ্চয়ই আপনাদের মনে পাড়বে । তাই জাতির এই ভবিষ্যত নেতাকে গড়ে তোলার দায়িত্ব হলো শিশুকাল থেকেই । আর জাতির নেতার সবচে বড়ো শিক হলেন বাবা এবং মা । কিন্তু কিভাবে শিশুকে প্রশিতি করতে হবে সেই দিক নির্দেশনা দেয়ার জন্যেই এ ধারাবাহিক আলোচনা । ইতিমধ্যে শিশু জীবনের দ্বিতীয় সপ্তবর্ষে বাবা মায়ের করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে । আজকের পর্বে শিশু জীবনের তৃতীয় সপ্তবর্ষ নিয়ে কথা হবে । শিশু জীবনের তৃতীয় সপ্তর্বষ শুরু হয় পনেরো বছর বয়স থেকে।এর শেষ সীমা হলো একুশ বছর পর্যন্ত। এ সময়টা শিশুর যৌবন প্রাপ্তির কাল,তারুণ্যের কাল। বয়োপ্রাপ্তি বা বালেগ হওয়ার বিচিত্র সংকট শিশুটির জীবনে প্রথমবারের মতো দেখা দেয় এই বয়স সীমায়। যৌবন প্রাপ্তির কারণে তাই শিশুর ভেতরে বিভিন্ন ধরনের ইচ্ছা-আকাঙা, ঝোঁক-প্রবণতা দেখা দেয়। শিশুর মনে ইচ্ছা জাগে অন্যদের সাথে বন্ধুত্বের জালে জড়িয়ে পড়তে। তার আর একা একা ভালো লাগেনা।বড়ো নিঃসঙ্গ-নিঃসঙ্গ লাগে নিজেকে। তাই শিশুকাল উত্তীর্ন নব যৌবন প্রাপ্ত তরুণ বন্ধু পরিবেষ্টিত থাকতে চায়,বন্ধুদের সাথেই কাটাতে ভালবাসে তার সময়গুলো। বন্ধু-বান্ধবের বৃত্তের বাইরে এই তরুণ নিজস্ব বৃত্তে থাকতেই পছন্দ করে,এ সময় তাই তার একটা নিজস্ব ভূবন সৃষ্টি হয়।সেই ভূবনের একাই সম্রাট সে,এতোদিন বাবা-মার কাছে তার কোন বিষয়ই গোপন ছিলনা,বা সে গোপন রাখতো না,এখন সে বাবা-মায়ের সাথে আলাপ-আলোচনায় অনেক বেশী সংযত ও ভারসাম্যপূর্র্ণ। কী চমৎকার পরিবর্তন। গতকালের উৎফুল্লময়,হেঁসে-খেলে বেড়ানো শিশুটি আবেগ-অনুভূতি ও সংবেদনশীল যৌবনে এসে কেমন শান্ত হয়ে গেছে। কতো দ্রুত সে মুক্ত পৃথিবী থেকে কন্টকাকীর্ণ বর্তমানে এসে পৌঁছেছে। সেই সাথে দ্রূত শারীরিক পরিবর্তন তার অন্তরে,মন ও মননে ব্যাপক প্রভাব ফেলে গেছে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতিও তার আকর্ষণ সৃষ্টি হতে শুরু করেছে। নব যৌবন প্রাপ্ত তরুণটির একটা বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে । সেটা হলো, তরুনটি এখন অতিমাত্রায় সংবেদনশীল এবং স্পর্শকাতর। অন্যদের আচার-আচরণ,কথাবার্তা তাকে দ্রুত ভাবিয়ে তোলে।কখনো সে চিন্তার গভীর অতলে ডুবে যায়,আবার কখনো অন্যদের কথার্বাতা নিয়ে পর্যালোচনা করতে বসে যায়। সব কিছু নিয়েই সে এখন গবেষণা করতে পছন্দ করে। তার সমবয়সী যারা,তারা যা করে, যা ভালোবাসে,সেও তা করতে করতে শেখে।এক কথায় সমবয়সী বন্ধু-বান্ধবদের আদর্শে সেও উজ্জীবীত হয়। তাদের আচার-আচরণ, চলা-ফেরা, কথাবার্তা প্রভৃতি অনুসরণ করতে শেখে।সমাজে মিশতে গিয়ে তরুণটি এক ধরনের জড়তা বা অসঙ্গতিতে ভোগে।যৌবন প্রাপ্তির আঙ্গিক যে প্রকাশটি লুকিয়ে আছে তার ভেতর,কদিন আগেও সে এ ব্যাপারে ছিল নিস্পৃহ । এখন ঐ গোপন জিনিসটাই যেন সবার সামনে বেরিয়ে পড়তে চায়। এই বুঝি তার যৌবন প্রাপ্তির গোপন রহস্যগুলো জেনে গেল সবাই। এই বিশ্রী ব্যাপারটা জেনে গেলে যে আর লজ্জার সীমা নেই---ইত্যাদি। এ ধরনের বিচিত্র টানাপোড়েন আর ব্যাক্তিগত প্রবণতায় তরুনটি ভুগতে থাকে।সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত তরুণেরা অস্থির মানসিকতায় ভোগে। একবার ভাবে,কিছু সামাজিক দায়িত্ব পালন করা যাক।এ দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে ব্যাপক তৎপরতা, পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে উঠে-পড়ে লেগে যায়।আবার কখনো কারো প্রতি আস্থাহীনতায় ভোগে। এমনকি কাজে কর্মে অধৈর্য হয়ে পড়ে। আবার কখনো নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবতে ভালবাসে অর্থাৎ নিজের মধ্যে কোনো রকম অপূর্নতা রয়েছে-তা ভাবতে চায়না।বরং ভাবে - আত্মনির্ভরশীল হবার সময় এসে গেছে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে,নিজের স্বাধীন জীবনকে নিশ্চিত করতে হবে ইত্যাদি।এই যে তরুনটির অস্থির চিন্তা, সিদ্ধান্তহীনতা এগুলো বাবা-মাকে উপলব্ধি করতে হবে।যৌবন প্রাপ্তির চলমান সংকট কালটি সন্তানের জন্যে খুবই সংবেদনশীল এবং স্পর্শকাতর সময়।এ বিষয়টি বাবা-মাকে অবশ্যই বুঝতে হবে এবংসন্তানের প্রতি আন্তরিকতা,স্নেহ ও ভালবাসাপূর্ণ ব্যবহার দেখিয়ে তার আস্থা অর্জন করতে হবে। কেননা,রাসূলে কারীম(সঃ) বলেছেন- তরুণদের প্রতি তোমরা সদয় হবে,কারণ এ সময় তাদের অন্তর খুবই কোমল ও নরম থাকে।তাই কখনো কখনো তরুণদের ভুল-ত্রুটিগুলোকে উপো অর্থাৎ দেখেও না দেখার ভান করতে হবে। তাকে কাছে টানতে হবে, তাকে সময় দিতে হবে এবং তার আত্মিক ও আনুভূতিক চাহিদাগুলো মেটাতে হবে।তরুণের সাথে বাবা-মায়ের সঠিক আচার-ব্যবহারের ফলে নবযৌবন প্রাপ্ত এই সন্তানের মধ্য থেকে শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্যগুলো ধীরে ধীরে দূর হয়ে যাবে।তাই তরুণটিও বুঝতে পারবে-সে এখন আর ছোট্র শিশুটি নেই, এখন তার বয়স হয়েছে,তার বুদ্ধি ও মেধার বিকাশ ঘটেছে, ফলে শিশুসুলভ আচরণ আর করা যাবেনা।এভাবে মেধা এবং বুদ্ধিতে সন্তানটি পরিপক্কতা লাভ করবে। ( ৭ম পর্ব) আপনার শিশু, আপনার সন্তান ঠিকমতো বেড়ে উঠেছে তো ! হ্যাঁ, তার ব্যাপারে সার্বনিক দৃষ্টি দেবেন । সন্তান চোখের আড়াল হলে খোঁজ খবর রাখবেন - সে এমন কোন কাজে জড়িয়ে পড়ছে কি না কিংবা এমন কোন আডডায় পড়ে গেল কিনা; যা তার সুন্দর ভবিষ্যতের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে । মনে রাখবেন, বাবা মায়ের অসতর্কতা বা অসচেতনতার সুযোগে সন্তান বিপথগামী হয়ে পড়ে । আর সন্তানের বিপথগামিতা যে কেবল সংশ্লিষ্ট পরিবারটির জন্যেই তিকর তা নয়, বরং গোটা সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্যেই তিকর । তাই সন্তানের প্রতি যথার্থ দৃষ্টি দিয়ে আপনার পরিবার, আপনার সমাজ তথা রাষ্ট্রের কল্যাণকে নিশ্চিত করবেন এই প্রত্যাশা রইল । আমরা ইতোমধ্যে শিশুর জীবনকালের প্রথম সপ্তবর্ষ,দ্বিতীয় সপ্তবর্ষ এবং তৃতীয় সপ্তবর্ষের বৈশিষ্ট্য ও বাবা-মায়ের করনীয় নিয়ে আলোচনা করেছি । আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, রাসূল (সাঃ) শিশুর এই ত্রি-সপ্তবর্ষকালকে তিনটি শব্দ দিয়ে এমনভাবে অভিহিত করেছেন যে,ঐ শব্দগুলো বিশ্লেষণ করলেই পর্বগুলোর বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রথমে পর্বকে অভিহিত করেছেন সাইয়্যেদ অর্থাৎ এ পর্বে শিশু হলো মহোদয়। তার খেদমত করা,তার কথা শোনা অন্যদের কাজ। দ্বিতীয় সপ্তবর্ষে শিশু হলো আনুগত্যকারী।আর তৃতীয় পর্বে রাসূল শিশুকে মন্ত্রী অর্থাৎ উজীর বলে অভিহিত করেছেন।তারমানে দাড়াঁলো,শিশু এরইমধ্যে তার আনুগত্য ও প্রশিক্ষণের পর্ব শেষ করে এসেছে।এখন পরিবার নামক রাষ্ট্রটির মন্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করবে।এই উপমা থেকে সহজেই অনুমিত হয় যে,পরিবার-রাষ্ট্রের রাজা-রাণী হলেন বাবা-মা।এখন যৌবনপ্রাপ্ত সন্তানটির দায়িত্ব হলো রাজাকে রাষ্ট্র পরিচালনায় সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা। এইসাথে আরেকটি বিষয় পরিস্কার হয়ে যায়,তাহলো বালেগ অর্থাৎ বয়োপ্রাপ্তির আগে পরিবারের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সন্তানের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই।তবে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার সাথে সাথেই সন্তানের উচিত পারিবারিক দায়িত্ব গ্রহণ করা এবং পরিবারের ভারী বোঝার একাংশ কাঁধে তুলে নেয়া।অন্যভাবে বলা যেতে পারে,সন্তান এ সময় বাবা-মায়ের উপদেষ্টা হবে,বন্ধু হবে,সর্বক্ষেত্রে সহযোগী হবে।তাই সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের সম্পর্ক নীবিড় হওয়া উচিত।বাবা-মাকে সন্তান যেমন শ্রদ্ধা-সম্মান দেখাবে,তেমনি বাবা-মা'রও উচিত সন্তানের ব্যক্তিত্বের প্রতি ল্য রাখা।এভাবে বিভিন্ন ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে পরস্পরের মধ্যে মত-বিনিময় হওয়া উচিত।অনেক বাবা-মা আছেন,নিজের সন্তান বলে,কিংবা ছোট্রবেলা থেকে বড়ো করে তুলেছেন বলে সন্তানকে বড়ো ভাবতে নারাজ।কেবল নারাজই নন,বরং কখনো কখনো এমনও বলে বসেন ‘‘সেদিনের ছেলে তুই,কী আর জানিস,'' "বড়োদের ব্যাপারে নাক গলাবেনা" ইত্যাদি। এরকম আচরণের ফলে সন্তানের ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগে।পরিণতিতে বাবা-মাকে সে অশ্রদ্ধা করে বসতে পারে।অথচ উচিত হলো,সন্তানের ব্যক্তিত্ব-বিকাশে বাবা-মায়ের আচরণে ছেলের যেন সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। এ বয়সটা সন্তানের চিন্তার স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব গঠনের বয়স। একটি কথা সকল বাবা মায়েরই মনে রাখা উচিত, তাহলো, সন্তান যত ছোটই হোকনা কেন, সেও কিন্তু পরিপূর্ণ একটি মানুষ । তার বোধ-বুদ্ধি, মেধা-মনন, চিন্তা ও বিবেক এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব রয়েছে । তার ঐ ব্যক্তিত্ব তথা সত্ত্বাকে কোনভাবেই খাটো করে দেখা ঠিক নয় । সন্তানের ব্যক্তিত্বকে খর্ব করা হলে সন্তানও বাবা-মায়ের ব্যক্তিত্ব খর্ব করতে দ্বিধা করবে না । ফলে সন্তান হয়ে যাবে বাবা-মায়ের অবাধ্য । অথচ প্রাপ্ত বয়সে সন্তানকে বেশ কিছু বিষয় চর্চা করতে হবে । এগুলো বাবা-মা-ই শেখাবে । সন্তান অবাধ্য হলে তা আর হয়ে উঠবে না । যেমন, এসময় ধর্মীয় বিষয়গুলো তাকে পালন করতে হবে । তাই বাবা-মাকে এমনভাবে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সন্তান ধর্মীয় বিধি-বিধান, আইন-অনুশাসন পুরো মেনে চলে । আগেই বলেছি, সন্তানের সকল সঙ্গতি-অসঙ্গতির ব্যাপারে প্রথমত : বাবা-মা-ই দায়ী । ফলে সন্তানের পরিশুদ্ধি, ধর্মের অনুশীলন ইত্যাদির ব্যাপারে প্রথমে বাবা-মাকেই পরিশুদ্ধ হতে হবে । ধর্ম চর্চা করতে হবে । বাবা-মা যদি ধর্মীয় ব্যাপারে উদাসীন হন তাহলে সন্তান কিছুতেই এ ব্যাপারে বাবা-মায়ের নির্দেশ মানবে না ।তাই বাবা-মায়ের মধ্যে ধর্মীয় ব্যাপারে কোন ত্রুটি থাকলে দ্রুত তা ঠিক করে ফেলা উচিত । নিজেরা ত্রুটিমুক্ত হলে সন্তানও ত্রুটিমুক্ত হবে । আর এটা তো খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার যে, বাবা-মা যা করে না, তা সন্তানকে করতে বললে সন্তান সাথে সাথেই প্রতিক্রিয়া দেখাবে । সন্তানের এই প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে মুক্ত থাকা প্রত্যেক বাবা-মায়ের কর্তব্য । কারণ এই প্রতিক্রিয়া না সন্তানের জন্যে মঙ্গলজনক, না বাবা-মায়ের জন্য । তাই বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা । তাদের সাথে আচার আচরণ, কথাবার্তা, চলাফেরায় সচেতন ও সতর্ক হওয়া । আর এই সচেতনতার জন্যে বাবা-মা' কে সন্তানের ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে । সন্তানের মন-মানসিকতা বুঝতে হবে । তাদের চাহিদাগুলো পূরনের ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে । তাদের ব্যক্তিত্বকে সম্মানের সাথে দেখতে হবে । তবেই সন্তানও বাবা-মাকে প্রদ্ধা করবে, তাঁদের প্রতি নির্ভরতা, বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করবে । নিজের মনের কথা, সমস্যা, চাওয়া-পাওয়া ইত্যাদি সকল ব্যাপারে বাবা-মায়ের সাথে আলাপ আলোচনা করবে , পরামর্শ করবে । ৮ম পর্ব সুস্থ জাতিগঠনের মূলে রয়েছে সন্তানের যথার্থ লালন, প্রশিক্ষণ ও বিকাশ । আপনারা নিশ্চয়ই মহান এই দায়িত্বটি যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছেন । অন্তত আমরা তাই প্রত্যাশা করি । শিশু জীবনের তৃতীয় সপ্তবর্ষে তার যৌবনপ্রাপ্তি সংক্রান্ত জটিলতা, বাবা-মাকে তাদের কাজে সহযোগিতা করাসহ অভিভাবকদের করণীয় বিষয়ে গত আসরে আমরা কথা বলেছি । কিন্তু যৌবনকাল পর্বে সন্তানের জীবনে যেহেতু এক ধরনের পরিবর্তন সূচিত হয় । তাই বাবা-মায়ের উচিত সন্তানকে একটি গাইড-লাইন দেয়া । আমরা সন্তানের যৌবন পর্ব নিয়েই আজ কথা বলবো । সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত তরুণটির আত্মোপলব্ধি তথা নিজের সম্পর্কে ভালো করে জানা এবং মুরব্বীদের পরিবেশের সাথে পরিচিত হবার জন্যে তাকে জানান দেওয়া অর্থাৎ দিক-নির্দেশনা দেবার প্রয়োজন রয়েছে । এ সময় প্রাকৃতিকভাবেই সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটতে থাকে । বিশেষ করে সন্তানটি না চাইলেও শারীরিকভাবে সে বিকশিত হতে থাকে ।আর এই শারীরিক বিকাশের সাথে সমান্তরাল গতিতে তার মানসিক ও আত্মিক বিকাশও ঘটতে থাকে । বলা যেতে পারে, শারীরিক বিকাশের সাথে এগুলোর সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে । তাই মনোদৈহিক বিকাশকালে বিশ্ব প্রকৃতি ও সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অমোঘ বিধান সম্পর্কে যথার্থ একটা ধারনা তাকে দেওয়া উচিত । স্বাভাবিকভাবেই তার এমন একজন মুরব্বী বা অভিভাবকের সাহচার্য প্রয়োজন, যিনি নিজে সৎ, জ্ঞানী এবং কল্যাণকামী । ব্যক্তিগত জীবন চর্চার ক্ষেত্রে তরুণটির আত্মচেতনা, নিজের আচার-আচরন, কাজ-কারবার, দৃষ্টিভঙ্গী ও প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে বোধ-বুদ্ধি ও চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে । কিভাবে জীবন যাপন করতে হবে তা তার জানা প্রয়োজন । বিশেষ করে যখন সে নিজেকে বুঝতে শেখে আমি কে, কোথায় আছি, এই পৃথিবীতে আসার উদ্দেশ্য কি ? এই পৃথিবীতে কিভাবে থাকা উচিত ইত্যাদি তার জানা উচিত । এ সকল প্রশ্নের যথার্থ উত্তর তার পাওয়া বা জানা উচিত । যাতে তার জীবনে ভারসাম্য আসে, জীবনকে সে মূল্যায়ন করতে শেখে এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যত নির্মাণে সম হতে পারে । ইংল্যান্ডের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ উসটাস সেশার বলেছেন " মানুষের মানুসিক অশান্তি ও অস্বস্তির কারণ সম্পর্কে আমি বহু গবেষনার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে,মানসিক অশান্তিগ্রস্ত ব্যক্তিরা শিশুকাল ও তরুণ বয়সে জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পর্কে ভালো কোন গাইড বা দিক-নির্দেশনা পায়নি এবং তাদেরকে যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি । তাদের অনেকেই এখন নিজেরাই বিবাহ করেছেন । এমনকি সন্তানেরও অধিকারী হয়েছেন । তাঁরা তাদের মনের অজান্তেই নিজেদের মানসিক ও আত্মিক অশান্তি ও অশ্বস্তিগুলো সন্তানদের ভেতর সংক্রমিত করছেন । অভিজ্ঞতা এমন একটি জিনিস, জীবনের ক্ষেত্রে যার কোন বিকল্প নেই । শিল্প বলুন, সাহিত্য বলুন, কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটক যাই বলুন না কেন, এই জীবন-অভিজ্ঞতারই ছান্দিক রূপায়ন মাত্র । অভিজ্ঞতার ওপরে বড়ো কোনো শিক্ষা নেই । প্রশিকও নেই । আর শিক্ষা প্রতিবন্ধকতা, জিজ্ঞাসা, প্রশ্ন বা সমস্যার সমাধান । জীবন চলার পথে যিনি যতো বেশী সমস্যার সম্মুখীন হবেন । তিনি ততো বেশী অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন এটাই স্বাভাবিক । ফলে জীবনের বয়স যার যতো বেশী, তাঁর অভিজ্ঞতার ভান্ডারও ততোটাই বেশী সমৃদ্ধ । একজন তরুণ যেহেতু বয়সের দিক থেকে বড়োদের চেয়ে অনেক ছোট , তাই জীবনের অসঙ্গতি আর সমস্যার মোকাবেলাও সে কম রয়েছে । তাই বড়োদের তুলনায় তার স্মৃতির ভান্ডার যেমন অসমৃদ্ধ তেমনি অভিজ্ঞতার ভান্ডারও শূন্য প্রায় । তরুণ ঝঞ্জা-বিক্ষুব্ধ এই পৃথিবীর চড়াই-উৎরাইয়ের সম্মুখীন বড়োদের তুলনায় কম হয়েছে । এমনকি জীবন চলার পথে বাধা-বিপত্তি বা সমস্যা, সে কমই মোকাবেলা করেছে । অবশ্য তরূণের জন্যে এই অবস্থার ভালো ও মঙ্গলজনক একটা দিকও রয়েছে । তাহলে তার অভিজ্ঞতার ভান্ডারটি এখনো পূত-পবিত্র অর্থাৎ কোনোরকম সমস্যা বা বাজে ঘটনা তার অভিজ্ঞতাকে এখনো কলুষিত করেনি । অন্যদিকে তরুণের সহজ সরল স্মৃতি ভান্ডারটিও এখন পর্যন্ত কোনরকম কালিমালিপ্ত হয়নি । তা এখনো পূত-পবিত্র আছে । এর ভালো দিকটা হলো, শিশু জীবনের সাথে তার দূরত্ব যেহেতু বড়োদের তুলনায় কম, সেহেতু এখনো সে তার শৈশবের স্মৃতিগুলো স্মরণ করতে পারে এবং তার কিছু কিছু আচার-আচরণ ও অনুভূতির কারণ সে এখন উপলব্ধি করতে পারে, বুঝতে পারে । যার ফলাফল হলো যখনই সে বুঝতে পারে যে তার নিজস্ব অমুক আচরণ ব্যবহারটি পছন্দনীয় নয়।তখনই সে খুব সহজেই তার কারনটি খুঁজে বের করে আত্মসংশোধন করে নিতে পারে। তরুণদের সামনে যেহেতু জীবনের বহু পথ পাড়ি দেবার অবকাশ রয়েছে, তাই নিজেকে আরো ভালোভাবে চেনারও অবকাশ রয়েছে তাদের। আর আত্মোপলদ্ধি দূঢ় হলে তরুণ নিজেই তার সামনে আসা অনাগতকালের জটিল ও কঠিন পরিস্থিতিগুলোকে যথার্থভাবে মোকাবেলা করতে সম হবে। তবে একটি কথা মনে রাখতে হবে, পরিস্থিতি বা সমস্যা যতোই জটিল বা কঠিন হোক না কেন, ধীর স্থিরভাবে বুদ্ধিমত্তার সাথে তা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে বাবা-মা বা অন্যান্য মুরব্বীদের অভিজ্ঞতাকেও কাজে লাগানো যেতে পারে। বাবা-মায়ের উচিত তাদের তরুণ সন্তানটিকে এইসব পরামর্শ দেয়া, যাতে জীবন সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রেও সন্তান বহির্মুখী চিন্তা না করে। ইংরেজিতে বলা হয়ে থাকে Life is not a bed of roses.অর্থাৎ জীবন কোন গোলাপ ছড়ানো বিছানা নয় বরং বিচিত্র কাঁটায় ভরা। তাই জীবনপথে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে চলতে হবে। আপনার সন্তানকে এই ধরণাটি দিতে ভুলবেন না আশা করি। ৯ম পর্ব স্বাস্থ্য সুরার অভাবে মানুষের রোগ-ব্যাধি হতেই পারে। এই রোগ-ব্যাধি চিকিৎসাযোগ্য। কিন্তু পারিবারিক শান্তি শৃঙ্খলা সুরার অভাবে যেসব রোগ-ব্যাধি দেখা দেয়,তার পরিণতি ভয়াবহ। এই রোগ ঘর ছেড়ে বাইরে,সমাজ থেকে রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রতিকার সহজসাধ্য নয়। তাই প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়াই একমাত্র উপায়। এই ব্যবস্থা ছোটবেলাতেই নিতে হবে। বিশেষ করে সন্তান যখন যৌবনে পা দেয়,তখন বাবা মাকে অনেক বেশী সচেতন থাকতে হবে। যৌবনে পদার্পন করার পর একটি সন্তানের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো তার আশেপাশের পরিবেশের সাথে পরিচিত হবার আগে নিজের সাথে পরিচিত হওয়া অর্থাৎ নিজেকে জানা। এই নিজেকে জানা সৃষ্টি জগতের একটা বিস্ময়। সৃষ্টি প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষের ভেতরে দুই ধরনের জ্ঞানের উপস্থিতি থাকে। একটি হলো প্রত্য জ্ঞান,অপরটি পরো জ্ঞান। পরো জ্ঞান হলো বই-পুস্তক পড়ে যে জ্ঞান আহরণ করা হয়,আর প্রত্য জ্ঞান হলো আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ জ্ঞান,যে জ্ঞানের সাহায্যে মানুষ নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে ভাবতে পারে এবং নিজের আচার-ব্যবহার সম্পর্কে আত্মপর্যালোচনা করতে পারে। তো নিজেকে চেনা বা নিজেকে নিয়ে পর্যালোচনা করার জন্যে প্রত্য জ্ঞানই হলো উপযুক্ত। অর্থাৎ আল্লাহ মানুষকে যেই জ্ঞান দিয়েছেন বা নবী-রাসূলদের মাধ্যমে শিখিয়েছেন,তা দিয়ে নিজেকে বিচার বিশ্লেষণ করাই উত্তম। বাইরের কোন তত্ত্ব বা দর্শন দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করার জন্যে তৎপর হবার চেয়ে প্রত্য জ্ঞানের সাহায্যে আত্ম-উপলব্ধির চেষ্টা করাই যে সঙ্গত-এই বোধ বা আইডিয়া যৌবনে পদার্পনকারী সন্তানদেরকে বোঝাতে হবে। এর কারন হলো মানুষ যেসব তত্ত্ব বা দর্শন আবিষ্কার করেছে সেসব কখনোই ভুলের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু মানুষ যখন তত্ত্ব-মত্ত্ব বাদ দিয়ে প্রত্য জ্ঞানের মাধ্যমে নিজেকে নিয়ে পর্যালোচনা করে,তখন কিন্তু ভুল খুব কমই হয়। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে-মানুষ তার নিজের সম্পর্কে সচেতন,যদিও সে তার ভুল-ত্র"টি ঢেকে রাখতে চায়। মানুষ যখন প্রত্য জ্ঞানের মাধ্যমে নিজেকে চেনে এবং আত্মসংশোধন করে তখন স্বাভাবিকভাবেই তার আচার-আচরণও সংশোধিত হয়ে যায়। আরেকটি কথা আপনাদের যৌবনপ্রাপ্ত সন্তানদেরকে বোঝাতে হবে তাহলো , জীবন মাত্রই চড়াই-উৎরাইময়,সাফল্য ও ব্যর্থতাময়। তাই সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা-সর্বাবস্থাতেই আত্মবিশ্বাসী থাকার মনোবল আপনাদের সন্তানের মধ্যে থাকতে হবে। জীবনের ভাঙ্গা-গড়ায় নিজেকে গড্ডলিকায় ভাসিয়ে দেওয়া আত্মবিশ্বাসী চরিত্রের লণ নয়। কোনো অবস্থাতেই দুঃখ-বেদনায় ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। আরো বোঝাতে হবে, সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর অটল-অবিচল বিশ্বাস রেখে জীবনের যে-কোনো ঘাত-প্রতিঘাতকে প্রতিহত করতে হবে। সাফল্যে অহঙ্কার করা যেমন ঠিক নয়,তেমনি ব্যর্থতায় ভেঙ্গে পড়া বা হতাশায় নিমজ্জিত হওয়াও ঠিক নয়। এ দুই অবস্থাই আপনার প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের জন্যে ভয়াবহ। জগদ্বিখ্যাত মনীষী-যাঁরা এই পৃথিবীর জন্যে নিজেদের শ্রম ও মেধা ব্যয় করে গেছেন,তাঁদের জীবনেও কিন্তু বহু উত্থান-পতন আর ভাঙ্গা-গড়ার ঘটনা ঘটেছে। তারপরও তাঁরা আত্মবিশ্বাসে অটল থেকে জ্ঞানচর্চা করে গেছেন, আল্লাহর বন্দেগি করে গেছেন। কোনোরকম অন্যায় করেন নি,সর্বদা সত্যের ওপর অটল থেকেছেন। এইসব মনীষীর জীবনী পড়ার জন্যে সন্তানদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাঁদের জীবনী পড়ে শিখতে হবে যৌবনের সংবেদনশীল সময়টিকে তাঁরা কীভাবে এতো পূত-পবিত্রতার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন। কীভাবে নিজেদের মেধা ও যোগ্যতাকে নৈতিক চরিত্র গঠনের কাজে ব্যয় করেছেন। কীভাবে ইনসানে কামেল বা পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার জন্যে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কীভাবে নিজেদের জীবনকে অন্যদের জন্যে ন্যায়কামী ও মঙ্গলের আধারে পরিণত করেছেন। এভাবেই জ্ঞানী-গুণীদের জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের যৌবনকালকে সমৃদ্ধ ও পবিত্রভাবে কাটানোর জন্যে আপনাদের সন্তানদের শেখাতে পারেন। বিশেষ করে নবী-রাসূলদের জীবনী যুবকদেরকে নৈতিক চরিত্র গঠনে যথার্থ সহযোগিতা করতে পারে। তাঁদের জীবনের সমস্যা-সঙ্কুল বিচিত্র পর্যায় এবং চড়াই-উৎরাই কীভাবে অতিক্রম করেছেন-তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আপনাদের যৌবনপ্রাপ্ত সন্তানেরা তাদের যোগ্যতা ও মেধাকে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করতে পারে। অন্যদিকে জীবনে যারা দুর্নীতি-অনাচার আর গোমরাহীর দিকে ধাবিত হয়েছে,তাদের অধিকাংশই যৌবনের সংবেদনশীল সময়ে ব্যাপক দূষিত পরিবেশের সম্মুখিন হয়েছে। সেই দূষিত পরিবেশের কুপ্রভাব পরবর্তীকালে তাদের ব্যক্তিত্বের ওপর পড়েছে। তাই যে সকল বৈরী ও দূষিত পরিবেশ তাদেরকে বিপথে নিয়ে গেছে,সেসব পরিবেশ থেকে সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত সন্তানদেরকে দূরে রাখার ক্ষেত্রে বাবা-মাসহ সকল অভিভাবককে সচেতন থাকতে হবে। সন্তানদেরকেও কৌশলে এ ব্যাপারে যথার্থ ধারণা দিতে হবে। কারণ যৌবন পর্যায়ের এই সঙ্কটগুলোর ব্যাপারে আপনাদের সন্তানেরা যদি না জানে,তাহলে তাদের অজান্তেই নিজেদের মানসিকতা ও ব্যক্তিত্বের ওপর দূষিত পরিবেশের এমন ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়তে বাধ্য, যার পরিণতিতে তাদের জন্যে অপো করবে এক জটিল ও অন্ধকার ভবিষ্যত। একটি যুবকের সামনে সাধারণত অফুরন্ত সময়ের অবকাশ থাকে। এ সময়কে সে বিচিত্র কাজে ব্যয় করার অধিকার সে রাখে। কিন্তু কীভাবে,কোন উদ্দেশ্যে বা কোন উপায়ে সে তার সময়কে কাজে লাগাবে-সেটাই হলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একজন ঈমানদার যুবক যার সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী ও ধারণা রয়েছে নিজের সম্পর্কে,সে তার নিজ জীবনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা বা পরিস্থিতিকে আল্লাহর প থেকে পরীক্ষা হিসেবে ধরে নিয়ে এই দুর্ঘটনাকে নিজের উন্নতি ও অগ্রগতির সোপান বলে গ্রহণ করে। শুধু তাই নয়,এই দুর্ঘটনা বা পরীক্ষাকে সে নিজের পরিপূর্ণতা বা বিকাশের একটা সুযোগ বলে মনে করে। তাই সমস্যার সিঁড়িগুলোকে সে অত্যন্ত সচেতনতার সাথে অতিক্রম করে নিজের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করে তুলতে পারে। একথা সর্বজনবিদিত সত্য যে,ধর্মীয় নেতা বা সমাজপতি তথা বিখ্যাত মণীষীদের যৌবনকালের সমস্যা নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে,তাঁরা তাঁদের সামনে আসা অপ্রত্যাশিত সমস্যাগুলোকে অত্যন্ত মেধা ও দক্ষতার সাথে যথার্থ পন্থায় মোকাবেলা করতে সম হয়েছেন। যৌবনে জীবন সমস্যার মোকাবেলায় বিজয়ী মণীষীদের মধ্যে এমুহূর্তে যে কয়জনের নাম মনে পড়ছে,তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইমাম খোমেনী (রহ),শেখ আনসারী,আল্লামা তাবাতাবাঈ এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের মধ্যে আইনস্টাইন,এডিসন,পাস্তুর প্রমুখ। সর্বোপরি বলা যায় , যৌবনে পদার্পনকারী আপনার সন্তানের জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গী যদি সঠিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক হয়, তাহলে তার জীবন হয়ে উঠবে উজ্জ্বল ও প্রশান্তিময়। সে গভীর অধ্যবসায়ের সাথে নিজ জীবন পর্যালোচনা করে এবং জীবন সংগ্রামে উত্তীর্ণ হয়ে নিরন্তর অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাবে এবং সাফল্যের সাথে তার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছার আনন্দ লাভ করতে সক্ষম হবে। এই আত্মবিশ্লেষণমূলক আলোচনাটি আপনাদের সন্তানদের জন্যে নয়,বরং আপনারা যারা ইতোমধ্যে বাবা-মা হয়েছেন বা হতে যাচ্ছেন,তাদের জন্যে। কারণ,আপনারা আপনাদের সন্তানদেরকে তাদের যৌবনের সংবেদনশীল সময়ে যাতে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে পারেন,সেটাই আমাদের লক্ষ্য । ১০ম পর্ব মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হলো সে তার নিজের দুর্বলতা বা অলসতাকে উপেক্ষা করে চলতে চায়। নিজের কাজের ভুল-ভ্রান্তি স্বীকার না করে ভুলের দায়-দায়িত্ব আরেকজনের ঘাড়ে চাপাতে চায়। ভুলকে ভুল বলে মেনে নিতে চায় না এবং ঐ ভুলটাকে পরিশুদ্ধও করতে চায় না। অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত যে,আমরা সাধারণত কাজকে নিজের মতো করে দেখতে অভ্যস্ত। অর্থাৎ কাজটা যেরকম হওয়া উচিত,কিংবা যেভাবে হওয়া উচিত হোক না কেন,আমরা চাই আমাদের মনমতো করে নিতে। আমাদের নিজেদের ভুল-ত্রুটি নিয়ে যে একটু ভাববো বা চিন্তা করবো,সেইটুকু মনের ঔদার্য আমাদের নেই। ফলে পরবর্তী পর্যায়েও আমরা আমাদের কাজেকর্মে ভুলের পুনরাবৃত্তির সম্মুখিন হই। এইভাবে যদি আমাদের জীবনের দিনগুলো কাটতে থাকে , তাহলে না আমাদের ভুল-ত্রুটিগুলো পরিশুদ্ধ হবে ,আর না আমরা জীবনের পূর্ণতার দিকে এক পা অগ্রসর হতে পারবো। এ কারণেই হযরত আলী ( আ ) বলেছেন,নিজেকে চেনা বা নিজেকে জানাই হলো সবচে উপকারী। নিজেকে জানার মাধ্যমে বিশ্বের স্রষ্টাকে জানা যায় বলে তিনি মনে করতেন। কারণ মানুষ যতোণ পর্যন্ত না নিজেকে চিনতে বা জানতে পারে,কিংবা নিজের ভেতরকার আশা-আকাঙ্ক্ষা বা উপলব্ধিগুলোকে যথার্থ ভাবে বিশ্লেষণ করতে না পারে,অথবা এই পৃথিবীতে তার আগমনের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে না জানে,ততোক্ষণ পর্যন্ত সে তার জীবনের সমস্যাগুলোকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারবে না। একটি যুবক বা কিশোর যদি তার যৌবনকালের বিভিন্ন সঙ্কট সম্পর্কে এবং এই পৃথিবীর সৃষ্টি পরম্পরা, মানুষ,পশুপাখিসহ অন্যান্য প্রাণীকূল সম্পর্কে একজন যথার্থ জ্ঞানীলোকের কাছ থেকে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করে,এবং যৌক্তিকও পবিত্র দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করতে সম হয়,তাহলে তার আদর্শচ্যুতির আশঙ্কা কমে যায়। অন্যদিকে যুবক সন্তানটিরও উচিত তার সংবেদনশীল ও সঙ্কটময় এই সময়ে নিজস্ব যৌবনের মর্যাদা সম্পর্কে জানা এবং বোঝা। যৌনতা সম্পর্কে বিচিত্র কৌতূহলে নিরন্তর চিন্তায় মগ্ন থাকা ঠিক নয়। কারণ এ সম্পর্কে অতিরিক্ত ভাবতে গেলে শয়তান এসে মাথায় ভর করবে। আর শয়তানের ফাঁদে একবার পড়ে গেলে জীবনটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। লেখাপড়া কিংবা জীবনের বৃহত্তর উদ্দেশ্য সবকিছুই ভেস্তে যাবে। যার পরিণতিতে যুবক সন্তানটির সকল মেধা ও যোগ্যতা বিফলে যাবে। একটি সন্তান যখন নবযৌবনে পৌঁছে,তখন তার দেহে শারীরবৃত্তীয় (এবং প্রাণ রাসায়নিক পরিবর্তন দেখা দিতে থাকে। ছেলে হোক,মেয়ে হোক এ বয়সটায় সবার মধ্যেই শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ একটা নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয়। সেইসাথে শরীরের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক এষধহফ বা গ্রন্থিগুলো এ্যাকটিভ বা তৎপর হয়ে ওঠে। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে,এই গ্ল্যান্ডগুলো যা কিছুই উৎপাদন করে তা শরীরের প্রয়োজনেই করে। তবে যৌন হরমোন বলে পরিচিত আভ্যন্তরীণ গ্রন্থিগুলো যেমন টেস্টোস্টেরন, প্রোজেস্ট্রোন এবং স্ট্রোজেন ইত্যাদি শারীরবৃত্তিয় কাজে এবং লৈঙ্গিক পূর্ণতার জন্যেই বেশীরভাগ তৎপর থাকে। এখন কথা হলো এই যে শারীরিক পরিবর্তন এবং নতুন এক অবস্থা ছেলেমেয়েদের মাঝে দেখা দেয়,এটা সৃষ্টি প্রক্রিয়ারই এক অমোঘ বিধান। উত্তর প্রজন্ম সৃষ্টির বৃহত্তর স্বার্থেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই শারীরিক বিধান দিয়ে দিয়েছেন। এগুলোর যথার্থ ব্যবহার বা প্রয়োগবিধিও তিনি বলে দিয়েছেন। সদ্য যৌবনলাভকারী সন্তানদেরকে এ সম্পর্কে যথার্থ ধারণা না দিলে এবং এর বৈধ প্রয়োগ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না দিলে তাদের ল্যচ্যুতি এবং আদর্শচ্যুতি ঘটতে পারে। যার পরিণতিতে সন্তানের জন্যে অপো করবে অন্ধকার এক ভবিষ্যত। এই শারীরিক অবস্থায় পৌঁছাতে ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে বয়সগত কিছুটা তারতম্য রয়েছে। ছেলেরা সাধারণত পণেরো বছরের পর আর মেয়েরা নয় বছরের পর থেকে এই শারীরিক অবস্থায় পৌঁছে। ছেলে এবং মেয়েদের বয়োপ্রাপ্তির এই অবস্থাটা বাবা-মা যদি সচেতন হন তাহলে তাদের কথাবার্তা এবং আচার-আচরণ থেকেই টের পেয়ে যেতে পারেন। ছেলেদের কণ্ঠে পরিবর্তন আর মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তনসহ আরো কিছু নিদর্শন আছে যা বাবা-মা লক্ষ্য করলেই অনুধাবন করতে পারেন। অনুধাবনের পর ছেলেমেয়েদেরকে যথার্থ দিক-নির্দেশনা দেবেন যাতে তারা যৌবনের এই ক্রান্তিলগ্নে কোনোরকম ভুল করে না বসে। আলোচনার এ পর্যায়ে সন্তানদেরকে প্রশিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে পিতামাতা বা অভিভাবকদের করণীয় সম্পর্কে খানিকটা ধারণা দেয়া সমীচীন বলে মনে করি । প্রথমেই আপনাকে মনে রাখতে হবে, সন্তানকে প্রশিক্ষণ দেবার জন্যে আপনার ছকে বাঁধা পরিকল্পনা ও অনুক্রমিক কর্মসূচি থাকা চাই। কোনোভাবেই সন্তানদের মধ্যে একজনের সাথে আরেকজনকে ভুলভাবে তুলনা করা ঠিক নয়। সন্তানদের মাঝে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সন্তানদের সাথে আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে দৃঢ় তবে সদয় এবং ফ্রি বা স্বাধীন হতে হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া বা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যাপারে তাদের সামনে বিভিন্ন দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে। তাদেরকে ধৈর্য এবং চিন্তা-ভাবনা করে কথা বলার শিক্ষা দিতে হবে। সন্তানদের উপলব্ধি মতা বৃদ্ধির ব্যাপারে এবং অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা থেকে বিরত থাকতে বাবা মায়ের উচিত সহযোগিতা করা। বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে সন্তানদের সাথে আলোচনা করার মাধ্যমে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ দেওয়া উচিত। তাদের ভেতরে চিন্তাগুলোকে এমনভাবে ঢুকিয়ে দিতে হবে যাতে নিজেরাই নিজেদের মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে পারে। ধরা যাক,আপনার সন্তানের কোনো একটা কাজে আপনি খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এমতাবস্থায় তার ওপর রেগে না গিয়ে বরং ঠাণ্ডা মাথায় তাকে কাছে ডেকে ঐ কাজটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করুন এবং এ ব্যাপারে তার কাছ থেকে ব্যাখ্যা চান। এর একটা ইতিবাচক দিক রয়েছে। তবে হুট করেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ না করে উপযুক্ত একটা সময়ে এবং পরিবেশে জিজ্ঞেস করা ভালো। মনে রাখতে হবে সন্তানদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা মানে তাদের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা কিংবা তাদের খেলাধূলা হৈ-হুল্লোড়ে বাধা দেওয়া নয়। অন্য কাউকে খারাপ কাজ করতে দেখলে পরিকল্পিতভাবে ঠাণ্ডা মাথায় এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে যাতে সন্তানও বুঝতে পারে এমন ধরনের কাজ করা ঠিক নয় এবং এ ধরনের কাজ করতে দেখলে বাধা দেওয়া উচিত। উপদেশ দেওয়ার সময় কোনোভাবেই যেন আদেশ-নিষেধ সুলভ প্রকাশভঙ্গি না থাকে। সেইসাথে সন্তানকে কোনোভাবেই চাপের মুখে রাখা যাবে না,তিরস্কার বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলা যাবে না,এমনকি ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে কিংবা মানসিকভাবে চাপ দিয়ে কোনো কাজ করানো যাবে না। সন্তানের সাথে যে-কোন আচরণের সময় তার বয়স,মেধা,পরিবেশ,তার মানসিক অবস্থা,তার অনুভূতি,তার স্মৃতিশক্তির বিকাশ,তার বেড়ে ওঠা ইত্যাদির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে এবং সে অনুযায়ী তার ওপর কাজের দায়-দায়িত্ব চাপাতে হবে। সর্বোপরি মনে রাখতে হবে উত্তম প্রশিক্ষণ হলো তাই,যা ভালোবেসে আন্তরিকতার সাথে দেওয়া হয়। আর উত্তম প্রশিক্ষণের ফলাফল হলো উত্তম পরিবার। এ যাবৎ আমরা যা কিছু আলোচনা করেছি,চেষ্টা করেছি আপনাদের সন্তানকে উপযুক্ত পন্থায় লালন পালনের ক্ষেত্রে যথার্থ দিক-নির্দেশনা দিতে। এই নির্দেশনা আমাদের নয়,বরং স্বয়ং রাসূলে কারীম ( সাঃ ) এর। তাই এই নির্দেশনা যে সন্তানের প্রতিপালনে বিজ্ঞানোত্তীর্ণ-তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আপনারা কতোটুকু অনুধাবন করতে পেরেছেন বা কতোটা উপকৃত হতে পেরেছেন-আমরা জানি না । তবে এ আলোচনা আপনাদের সামান্যতম উপকারেও যদি এসে থাকে,তাহলে আমাদের প্রচেষ্টাকে সফল বলে মনে করবো। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর বিধান থেকে যথার্থভাবে উপকৃত হবার তৌফিক দিন। মূল লেখাটি তেহরান রেডিও -এর সাইটে । |