গ্রামীণফোনের কল্যাণে বাংলাদেশে এসে আমি প্রথম ইন্টারনেট ব্যবহার করি ২০০৬ বা ২০০৭ এ। আমাদের নোকিয়া ফোনের ০-তে চেপে ধরে গ্রামীণফোনের হোম পেইজে গিয়ে পিকচার/এনিমেশনগুলো বার বার দেখা পর্যন্তই ছিল আমার ইন্টারনেট ব্যবহারের সীমা। এখনও মনে আছে, এক ঘণ্টা যেতে না যেতেই দেখি লেখা আসে " Authentication failed” এক দৌড়ে এক দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? তিনি বললেন তোমার টাকা শেষ। আমি ৩০০ টাকা ঢুকিয়ে আবার শুরু করলাম। এভাবে আমার প্রথম ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু হয়।
শুরুর বেশ কিছু দিন শুধু ব্রাউজিং করে কাটালাম। এর পর শুরু হল অ্যাকাউন্ট খোলা। mig33, nimbuzz, yamee, yahoo, gmail, hotmail, livemail, ymail, ovimail, facebook,myspace, hi5,skype, ইত্যাদি সবগুলাতে একাউন্ট খোলা শুরু করলাম। Mig33/nimbuzz এর চেটরুমে চেটিং এ পড়ে থাকতাম।
এভাবে ধীরে ধীরে আমি কিংবা আপনি ইন্টারনেটের জগতে পা বাড়ালেন।শুরু হল পৃথিবীর সাথে যুক্ত হওয়ার পথ। কিন্তু আপনি কি জানেন ঠিক তখন থেকে, আপনি আপনার নিজের তথ্যের নিরাপত্তা হারানো শুরু করলেন। মূল লেখায় যাওয়ার আগে বলে রাখি ইন্টারনেটে আমাদের সিকিউরিটি বলতে আমি কি বুঝাচ্ছি।আমাদের ডাটা বা তথ্যের অবাধ ব্যবহারে আমাদের সতর্কতা বাড়ানো আমার মূল লক্ষ্য। ইন্টারনেট জগতে আমাদের তথ্য যত গোপন থাকবে আমরা তত নিরাপদ। ধরেন আমার জিমেইল, ইয়াহু ইত্যাদিতে একাউন্ট আছে। আরেক জনের কিছুতেই একাউন্ট নেই। এখন আপনি বলেন কার পার্সোনাল তথ্য নিরাপদে আছে, আমার না তার? তাহলে কি আমরা ইন্টারনেট ব্যবহার করবো না? অবশ্যই করবো, কিন্তু আমাদের সতর্ক থেকে করতে হবে।
ইন্টারনেটের কল্যাণে চাইলেই আমরা যে কারোর সাথে তথ্য আদান প্রদান করতে পারছি নিমিষেই। কিন্তু অনলাইনে নিজেকে নিরাপদ রাখা কতোটা জরুরি? আপনার তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে আপনাকেই ভাবতে হবে। অনলাইনে নানান রকমের সাইবার অপরাধ হয়ে থাকে, আর সাইবার অপরাধীরা সর্বক্ষণ লেগে থাকে আপনার তথ্য চুরি করার জন্য। হতে পারে সেটা আপনার ইমেইল/ফেইসবুকের পাসওয়ার্ড কিবা ক্রেডিট কার্ড ডিটেইলস! এভাবে চুরি হতে পারে আপনার অফিস কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ডাটা। অথবা আপনার ব্যাংক একাউন্টের ইনফরমেশন। সাইবার অপরাধীরা আপনার কম্পিউটারে একটি ম্যালওয়্যার বা ট্রোজেন ইন্সটল করে খুব সহজেই হাতিয়ে নিতে পারে আপনার এসব সংবেদনশীল তথ্য। মনে করেন আপনি ইন্টারনেট থেকে ‘থ্রি ইডিয়টস’ মুভিটা ডাউনলোড করলেন আর মনের আনন্দে দেখলেন! (সব চেয়ে বেশি হয় পর্ন ছবিতে) কিন্তু আপনি কি জানেন, আপনার অজান্তেই ওই মুভিটির সাথে হ্যাকারের বাইন্ড করে দেয়া ম্যালওয়্যার/ ট্রোজেন আপনার কম্পিউটারে ইন্সটল হয়ে গেছে! আর হ্যাকারের হাতে চলে যাচ্ছে আপনার প্রিয় মানুষের সাথে কাটানো অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও কিংবা ছবি!
যার মাধ্যমে সে আপনার থেকে আদায় করতে পারে মোটা অংকের টাকা। নতুন করে যাদের মাথায় হ্যাকিং এর ভূত ঢুকে, তাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা না দিলেই নয়।মনে করেন কারো হ্যাকার হওয়ার খুব ইচ্ছে হলো, আর সে ইন্টারনেট থেকে অনেক গুলো হ্যাকিং এর সফটওয়্যার ডাউনলোড করলো।কিন্তু, এসব সফটওয়্যার-ই হতে পারে সাইবার অপরাধীদের বানানো ম্যালওয়্যার, এবং সবচেয়ে বেশি এগুলোতেই থাকে। শুধু ট্রোজেন কিংবা ম্যালওয়্যার-ই নয়, আরো অনেক ভাবেই এর শিকার হতে পারেন আপনি। মনে করেন, একটি ফ্রী ওয়াইফাই জোন পেয়ে আপনি মনের আনন্দে ডাউনলোড করা শুরু করে দিলেন। কিন্তু আপনি জানেন কি একই নেটওয়ার্কে বসে হ্যাকার সহজেই হাতিয়ে নিতে পারে আপনার ফোন বা কম্পিউটারের কুকি। এই কুকির মানে কিন্তু বিস্কিট না, আপনার ফোন বা কম্পিউটারের কুকি, হ্যাকার নিজের সিস্টেমে রিপ্লেইস করে, ফেসবুক, ইমেইল বা অন্যান্য পাসওয়ার্ড না জেনেই আপনার অ্যাকাউন্টসের এক্সেস নিয়ে নিতে পারে (কুকি নিয়ে আমার লেখা) ! ধরে নিলাম আপনি অনেক সচেতন মানুষ, আপনি আমার উল্লেখ করা এসব ফাঁদে কখনোই পা দিবেন না। কিন্তু তারপরও একটি প্রশ্ন! আপনি এবং আপনার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কি নিরপরাধ? উত্তর- না!
প্রতিদিন আমরা যেসব সাইট ভিজিট করি সেগুলোর মাধ্যমেও কিন্তু আমরা ফেঁসে যেতে পারি। আপনি প্রতিদিন আপনার প্রয়োজনীয় যেসব সাইট ভিজিট করছেন তার মধ্যে একটি নিউজ পেপারের সাইট হঠাৎ একদিন হ্যাক হয়ে গেলো! আর হ্যাকারও অন্য হ্যাকারদের রাস্তায় না হেঁটে একটু অন্য পন্থা অবলম্বন করলো। মানে সাইট ডিফেস না করে সাইটের স্ক্রিপ্টে তার বানানো কুকি স্টিলার (Cookie stealing script) বসিয়ে দিলো! আর আপনি যখন ওই সাইটে ভিজিট করলেন আপনার ব্রাউজারে জমা থাকা কুকি চলে গেলো হ্যাকারের হাতে। আর সে এটি ব্যবহার করে আপনার এক্টিভ সেশন গুলোর এক্সেস নিয়ে নিলো! কিন্তু, আপনি বুঝতেও পারলেন না আপনার সাথে কি হতে যাচ্ছে! আমি এতক্ষণ আপনাকে যা বললাম তার কিচ্ছু কাজে নাও লাগতে পারে। কারণ এখনকার সাইবার অপরাধী বা ডিজিটাল চোরেরা আগের থেকে অনেক স্মার্ট হয়ে গেছে। আপনি কি এখনো ঘুমিয়ে আছেন? নাকি এখনো এমন করে ভাবেন নি?
জেগে উঠুন আর আপনার তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবা শুরু করে দিন। আমাদের কাছে প্রায় প্রতিদিন ৫০ এর অধিক মেসেজ আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মেসেজ আসে ফেসবুক হ্যাকিং অথবা হ্যাক হয়ে যাওয়া ফেসবুক উদ্ধারের জন্য। আমরা যদি একটু সতর্ক থাকি তাহলে আমাদের এই বিপদে পড়তে হবে না। ইমেইল এর নিরাপত্তা, ফেসবুক আইডির নিরাপত্তা, ক্রেডিট কার্ডের নিরাপত্তা নিয়ে খুব বেশি কিছু না বললেও বেশ কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য দেব।
ইমেইল একাউন্ট সিকিউর রাখবেন যেভাবে-
সাধারণত একজন হ্যাকার চাইবে আপনার ইমেইল অ্যাকাউন্টসের এক্সেস নিতে, এর কারণ আপনার ইমেইল অ্যাকাউন্টসের সাহায্যে হ্যাকার খুব সহজেই আপনার ফেসবুক কিংবা যে কোনো কিছুর পাসওয়ার্ড রিসেট করে নিতে পারবে। তাই অনলাইনে নিরাপদ থাকার জন্য আপনার ইমেইল আইডির নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা অনেক জরুরি। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের প্রায় সব ইন্টারনেট ব্যবহারকারির জিমেইল একাউন্ট আছে। এর পিছনে আছে অনেক কারণ। এক জিমেইল একাউন্ট থাকলে এন্ড্রয়েড মোবাইলে প্লে-স্টোর, ইউটিউব, কেলেন্ডার ইত্যাদি গুগোলের ফিচারে ইজিলি এক্সেস পাওয়া যায়। তাই ইন্টারনেট ইউজাররা অন্যান্য মেইলিং সার্ভিসের সাথে জিমেইল ব্যবহার করেন। তাই আমি আজ শুধু জিমেইলের অ্যাকাউন্ট সেকিউর রাখার কিছু টিপস দেব।
১। প্রথমে এই লিঙ্কে যান https://myaccount.google.com/ তারপর "Security Checkup" অপশন থেকে Get Started এ ক্লিক করে পরবর্তী স্টেপ ফলো করুন।
২। আপনার অ্যাকাউন্ট রিকভারি অপশন অপটুডেট রাখুন। নিচের লিঙ্ক থেকে https://myaccount.google.com/security।
৩। আপনি যদি আপনার ইমেইল অ্যাকাউন্টসে 2nd Step verification চালু করে রাখেন, তাহলে আপনার অ্যাকাউন্টসে পাসওয়ার্ড দিয়ে প্রবেশ করার পর একটি ইউনিক কোড চাওয়া হবে, আপনি যদি এই কোডটি দিতে ব্যর্থ হন তাহলে আপনাকে আপনার অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করতে দিবে না। আর পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করার পর স্বয়ংক্রিয় ভাবে আপনি ইমেইল অ্যাকাউন্ট খোলার সময় যেই ফোন নাম্বারটি দিয়েছিলেন ওই নাম্বারে এসএমএস এর মাধ্যমে একটি ইউনিক কোড চলে আসবে।
আর একজন হ্যাকার যদি আপনার ইমেইল অ্যাকাউন্টসের পাসওয়ার্ড পেয়েও যায়, তাহলেও তার পক্ষে আপনার ইমেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা সম্ভব হবে না, কেন না সে আপনার ফোনের এক্সেস নিতে পারবে না। এতক্ষণে নিশ্চই বুঝে ফেলেছেন, কিভাবে আপনার ইমেইল অ্যাকাউন্টের সিকিউরিটি দুর্ভেদ্য করা সম্ভব?
চলুন এইবার দেখে নিই কিভাবে আপনার জিমেইল(gmail) অ্যাকাউন্টে 2-Step verification অপশনটি চালু করবেন। প্রথমে http://accounts.google.com/smsauthconfig লিংকে প্রবেশ করে, ‘সেটআপ শুরু করুন’ বা ‘Start Setup’ যেটাই থাকে ওখানে ক্লিক করুন। তার পর আপনার অ্যাকাউন্টের সাথে যুক্ত ফোন নাম্বারটি দেখতে পাবেন, এর একটু নিচের থেকে ‘Send Code’ বা ‘কোড পাঠান’ এ ক্লিক করুন। সাথেসাথে আপনার ফোন নাম্বারে Google থেকে একটি এসএমএস আসবে। নতুন আসা পেইজে Google থেকে আসা কোডটা লিখে ‘Check’ বা ‘যাচাই’ এ ক্লিক করলে আরেকটি পেইজ আসবে ওখানে ‘Next’ চাপুন তারপর ‘Confirm’ করুন। ব্যস চালু হয়ে গেলো এখন থেকে কেউ আপনার পাসওয়ার্ড জেনে গেলেও আর আপনার অ্যাকাউন্টে লগইন করতে পারবে না।
৩। আপনার অপারেটিং সিস্টেম আর ব্রাউজার আপটুডেট করে রাখবেন।
৪। password এর নিরাপত্তা আপনাকেই দিতে হবে। যে কোনো সাইটে ডাইরেক্ট লগইন হবেন না আপনার ইমেইলের পাসওয়ার্ড দিয়ে। এই দুই লিঙ্ক ছাড়া mail.google.com অথবা accounts.google.com/Login অন্য কোনো লিঙ্ক হলে Avoid করবেন।
৫। পাবলিক কম্পিউটার ব্যবহার করলে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করুন। কাজ শেষে সাইন আউট হয়ে নিবেন। ctrl+shift+delete দিয়ে ব্রাউজারের forms, passwords, cache, and cookies ক্লিয়ার করবেন।
যেহেতু ফেসবুকের মাধ্যমে আমাদের নিরাপত্তা বিঘ্ন হতে পারে তাই ফেসবুক নিরাপদ রাখার কিছু ট্রিক্স দিচ্ছি !
ফেসবুক বলেন আর ইমেইল বলেন, পেপাল একাউন্ট বলেন আর ব্যাঙ্ক একাউন্ট বলেন এগুলা হ্যাক হওয়ার পিছনে আপনার সাহায্য থাকে। ধরেন কেউ আপনাকে মেসেজ করল। " দেখো অমুক মডেল বা নায়িকার একটা ভিডিও http:www.ট্রিপাল***.com ”। আপনি লোভ সামলাতে না পেরে ক্লিক করলেন। পরে দেখলেন আপনার ফেসবুক লগআউট হয়ে গেল। পরের দিন দেখলেন হ্যাকড। আপনার দোষে আপনার একাউন্ট খোয়ালেন। তাইনা !
এখানে প্রথম ভুলটা কার ?
হ্যাকারের ?
না, আপনার !
আপনি একটু সতর্ক থাকলেই এই ভুলটা হয় না !
ফেসবুক আইডি নিরাপদ রাখার ১০ টি উপায় !
১। আপনার মোবাইল এবং ইমেইল ভেরিফাই করে রাখেন। আশা করি এটা ইমেজ দিয়ে দেখাতে হবে না !
২। কঠিন পাসওয়ার্ড দিন। “ic@Ta@i2@01@2” এইটা একটা ভাল পাসওয়ার্ডের উদাহরণ হতে পারে ।
৩। লগইন এপ্রভাল এড করে রাখেন ! Account Settings > Security
৪। login Notification কে enable করেন !
৫। ট্রাস্টেড কন্টাক্ট এড করে রাখেন তাহলে কেউ আপনার আইডি নাড়া চাড়া করার সাথে সাথে আপনার ট্রাস্টেড ফ্রেন্ডের কাছে কোড যাবে। হ্যাকড আইডি ফিরে পেতেও হেল্প করবে !
৬। ফ্রেন্ডলিস্ট লুকিয়ে রাখবেন ! অনেকে ৫০০০ ফ্রেন্ড এর লিস্ট দেখানোর জন্য এটা পাবলিক করে রাখে ! কিন্তু আপনি কি জানেন এটি আপনার জন্য অনেক বিপদ ডেকে আনতে পারে এই জিনিসটা !
৭। কিছু দিন পরপর বা যদি মনে হয় কেউ ঢুকছে তাহলে আপনি Active Session থেকে গিয়ে unfamiliar activity গুলো এন্ড করেন ! End activity তে ক্লিক করলেই হবে।
৮। safe browser use করবেন ! CTRL+SHIFT+N এ ক্লিক করেন এটা করতে পারেন।
৯। untrusted কারো কাছ থেকে কোন মেসেজ পেলেই ক্লিক করবেন না ! স্পাম সব কিছু এড়িয়ে যাবেন। আন্ট্রাস্টেড কোনো এপ্লিকেশনের পার্মিশন দিবেন না
১০। পৃথিবীর কাউকে বিশ্বাস করবেন না !
:-p
দারুণ লেখেন ভাই আপনি,,,,,,,,,, thanks