রং করা আমাদের দৈনন্দিন জীবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। আমরা প্রায়শই বাড়ি, গাড়ি কিংবা আসবাবসহ অনেক কিছুই রাঙিয়ে থাকি ইচ্ছেমতো। আমরা কি আসলে জানি কোথায় কেমন রং ব্যবহার করা উচিত? ক’জনেই বা জানি বছরের কোন সময় রং করা উচিত কিংবা রং কত ধরনের হয়। বাস্তবিক জীবনে এ বিষয়ে কোন জ্ঞান না থাকলে আমরা ভুল রং করে অনেক দামি জিনিসকেও সস্তা করে ফেলি। তাই আজকের এই টিউনটি আশাকরি আপনাদের কনফিউশনকে দূর করে দেবে।
রং। এটি এমন এক জিনিস যা নির্বাচন কিংবা প্রস্ততকরণ অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। রং প্রস্তুতকরণ বলতে রঙের মিশ্রণ তৈরির কথা বলছি। তবে প্রাথমিকভাবে আমরা যেখানে ধাক্কা খেয়ে থাকি তা হলো রং নির্বাচন। শিল্পী ছাড়া এ ব্যাপারে ভুল করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। হয়তো কোন রং দেখে কখনো ভালো লাগে। পরে আমরা তা কপি করার চেষ্টা করি। কিন্তু যেখানে পেইন্ট করা হবে তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রং না হলে তা সুন্দর না হয়ে অসুন্দর-ই হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তবুও বার বার আমরা রং নির্বাচনের ক্ষেত্রে একই ভুল করতে থাকি। তবে ভাবছেন কোথায় কোন রং করবেন?
পৃষ্ঠতল বা সারফেসের উপর ভিত্তি করে রং এবং পেইন্টিংয়ের ধরন ভিন্ন ভিন্ন হবে। সে বিষয়ে আমরা নিজেরা অনেক ক্ষেত্রে বুঝি না। কেমন হতে পারে একেক পৃষ্ঠতলের রংয়ের ধরন?
ডিসটেম্পার : ইট, কংক্রিট ও প্লাস্টারের উপর ডিসটেম্পার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের ডিসটেম্পার, যেমন-অ্যাক্রেলিক, সিনথেটিক, ড্রাই ইত্যাদি। অ্যাক্রেলিক ডিসটেম্পার পানি দিয়ে ধোয়া যায়। কিন্তু সিনথেটিক ও ড্রাই ডিসটেম্পার পানি দিয়ে ধোয়া যায় না।
প্লাস্টিক পেইন্ট : প্লাস্টিক ইমালশন নামেই বেশি পরিচিত। এটি মূলত পানি বেজড রং, যা দীর্ঘস্থায়ী ও ধোয়া যায়। প্লাস্টিক পেইন্ট তিন ধরনের। রেগুলার, ইকোনমিক ও প্রিমিয়ার ইমালশন।
বাড়ির বাইরের দিকে আবহওয়ার প্রভাব থাকে। তাই বাড়ির ভেতর থেকে বাইরের রং ভিন্ন হয়।
সিমেন্ট পেইন্ট : এটি এক ধরনের পানি প্রধান রং। সাধারণত বাইরের দেয়াল, নিরাপত্তা দেয়াল ইত্যাদি রকমের আবহাওয়ার প্রভাবযুক্ত বা উন্মুক্ত পৃষ্ঠতলে সিমেন্ট পেইন্ট বিশেষভাবে কার্যকরী।
ওয়েদার কোট: ওয়েদার কোটের চারিত্র প্রায় সিমেন্ট পেইন্টের মতোই। তবে পার্থক্য হলো ওয়েদার কোট সিমেন্ট পেইন্টের চেয়ে বেশি মসৃণ এবং এর অনেক কালার ভেরিয়েশন রয়েছে।
ব্যবহারের ক্ষেত্র, কার্যক্ষমতা, প্রয়োগের ক্ষেত্রসহ নানাবিধ প্রেক্ষিতে পেইন্ট বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। দেশ ও বিদেশে সাধারণত যে পেইন্টগুলো সবচেয়ে জনপ্রিয় তা নিচে উল্লেখ করা হলো:
এনামেল পেইন্টগুলো শক্ত ও চকচকে কোট হিসেবে দারুণ কাজ করে। বার্ণিসের সাথে রঙ্গক এবং জিংক ও সীসার সংমিশ্রনে তৈরি করা হয় এ ধরনের পেইন্ট। এনামেল পেইন্ট যে কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক থেকে আপনার সম্পত্তিকে সুরক্ষা দেবে। এছাড়াও এনামেল পেইন্ট জলরোধী হওয়ায় ভবনও দীর্ঘস্থায়ী হবে। দরজা, জানালা, ভেতর ও বাইরের দেয়াল এবং প্রায় সব স্থানেই এনামেল পেইন্ট ব্যবহার করা যায়। তবে এর অসুবিধা হলো এনামেল পেইন্টের সঠিক কার্যকারিতা পেতে এর উপর দরকার টাইটানিয়ামের প্রলেপ, তাছাড়া এনামেল পেইন্ট শুকাতে একটু বেশি সময় লাগে।
এই ধরনের পেইন্টের মূল উপাদান হলো সাদা সীসা। অন্যান্য রংয়ের মতো ওয়েল পেইন্ট বা তেল রং একবারে প্রয়োগ করা হয় না। ওয়েল পেইন্ট প্রয়োগ করা হয় তিন স্তরে। প্রথমটি হলো প্রাইমার বা প্রাইমারি কোট, দ্বিতীয়টি আন্ডারকোট এবং সর্বশেষে ফিনিস কোট বা ফাইনাল টাচ। এই পেইন্ট দুই প্রকারে বাজারে পাওয়া যায়, একটি হলো ম্যাট এবং অন্যটি চকচকে।
তেল রং একটি জনপ্রিয় পছন্দ হওয়ার কারণ হলো এটি দীর্ঘস্থায়ী এবং দামে সস্তা। ওয়েল পেইন্ট প্রয়োগ করা এবং প্রয়োজনে পরিস্কার করা বা তুলে ফেলাও তুলনামূলক সহজ। এই পেইন্ট প্রায়ই দেয়াল, দরজা, জানালা, এবং ধাতব আইটেমগুলোতে ব্যবহার করা হয়। ওয়েল পেইন্টের অনেক সুবিধা রয়েছে তবুও অসুবিধাতো থাকবেই। এর উল্লেখযোগ্য অসুবিধা হলো, ওয়েল পেইন্ট আর্দ্র পরিবেশে ভাল কাজ করে না এবং সম্পূর্ণ শুকাতে বেশি সময় লাগে।
ইমালসন শব্দটির অর্থ দুটি তরলের মিশ্রণ। এ মিশ্রণ সাধারণ কোন মিশ্রণকে বুঝায় না। ইমালসন হলো এমন এক ধরনের মিশ্রণ যেখানে দুটি তরল পদার্থ পাশাপাশি অবস্থান করে মাত্র কিন্তু কেউ কারো সাথে মিলে যায় না। সহজ অর্থে বললে তেল এবং জলের মিশ্রণের কথা বলা যেতেই পারে। তেল এবং জল মিশ্রণ করতে গেলে সবসময় লক্ষ্য করা যায় জলের উপর তেলের আলাদা একটি স্তর থাকে।
জল হল প্রধান বাহন/মাধ্যম যেখানে রঙ্গক, বাইন্ডার এবং অ্যাডিটিভ (যা পেইন্ট তৈরির সর্বশেষ ধাপে ব্যবহার করা হয় পেইন্টটি দ্রুত শুকানোর জন্য) যোগ করা হয়। ইমালসনের পেইন্টের ক্ষেত্রে বাইন্ডার হিসেবে ব্যবহার করা হয় পলিমার। এই পলিমার বাইন্ডার দেয়ালে বা যেখানে পেইন্ট করা হবে সে পৃষ্ঠে একটি অবিচ্ছিন্ন ফিল্ম তৈরি করার জন্য ইমালসন পেইন্টে তা ব্যবহার করা হয়। পেইন্ট তৈরিতে ব্যবহৃত বাইন্ডারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইপোক্সি, এক্রোলিক, রজন এবং অ্যালকিড রজন। ইমালসন পেইন্টগুলো খুবই নমনীয়। এটি দ্রুত শুকিয়ে যায় এবং ভবনের ভেতর ও বাইরে উভয় পৃষ্ঠেই তা ব্যবহার করা যেতে পারে।
সিমেন্ট পেইন্ট হলো কেটি জল-ভিত্তিক পেইন্ট তবে সিমেন্ট পেইন্টের মূল উপাদান হলো সিমেন্ট। সিমেন্টই যখন এ পেইন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এটি ভবনের দেয়ালকে সর্বাধিক দৃঢ়তা এবং কঠোরতা প্রদান করতে পারে। সিমেন্ট পেইন্ট ভবনের ভেতর এবং বাইরে উভয় দেয়ালেই ব্যবহার করা যায়।
ভবনে সিমেন্ট পেইন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো এটি পানি প্রতিরোধী। তাছাড়া ধুলো বালির হাত থেকে ভবনকে সুরক্ষা দেয় এই পেইন্ট।
প্রয়োগের সহজতার কারণে বর্তমানে বাজারে সহজলভ্য হওয়ায় বেশিরভাগ ওয়াল পেইন্টই জল-ভিত্তিক। যদি আপনার বাড়ির দেয়ালগুলো আগে ওয়েল পেইন্ট করে থাকেন তবে জল-ভিত্তিক পেইন্ট করার সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করুন। পেইন্ট করার আগে ওয়েল পেইন্ট করা থাকলে তা ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
তেল এবং জল ভালোভাবে মিশে না। তাই ভালোভাবে পরিস্কার না করলে জল ভিত্তিক পেইন্ট নিখুঁত হবে না। পরিস্কার করার পর একটি মাঝারি থেকে মসৃণ দানাযুক্ত স্যান্ডপেপার দিয়ে পুরোটা ঘষে পরিস্কার করুন। তারপর জল ভিত্তিক পেইন্ট দেয়ালে যুক্ত করতে হবে।
বিটুমিনাস পেইন্ট দ্রবীভূত অ্যাসফাল্ট বা আলকাতরা থেকে তৈরি করা হয় যা এটিকে তার স্বতন্ত্র কালো আভা দেয়। এটি জলরোধী এবং ক্ষার-প্রতিরোধী। এ ধরনের পেইন্ট সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসতে পারে এমন স্থানে করা উচিত নয়। এর ফলে বিটুমিনাস পেইন্ট বেশি দিন স্থায়ী হবে না।
পানির নিচে লোহার কাজ, কংক্রিটের ভিত্তি, কাঠের উপরিভাগ এবং লোহার পাইপে প্রায়ই বিটুমিনাস পেইন্ট দেখা যায়। এর ফলে মরিচার হাত থেকে রক্ষা পাবে আপনার সম্পত্তি। আর এটিই হলো বিটুমিনাস পেইন্টের বিশেষত্ব।
আমরা বিভিন্ন ধাতব বস্তুর উপর রুপালি রংয়ের ঝকঝকে এক ধরনের পেইন্ট দেখতে পাই যা মূলত অ্যালুমিনিয়াম পেইন্ট। এই পেইন্টটি তেল বার্নিশের সাথে অ্যালুমিনিয়াম কণার সমন্বয়ে তৈরি করা হয়। মরিচা প্রতিরোধ, বিদ্যুৎ এবং আবহাওয়া প্রতিরোধী হিসেবে এ ধরনের পেইন্ট করা হয়। বিশেষত গ্যাস ট্যাঙ্ক, তেলের ট্যাঙ্ক, জলের পাইপ এবং রেডিয়েটার সহ বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে অ্যালুমিনিয়াম পেইন্ট ব্যবহার করা হয়।
ধাতব বস্তু বাতাসের সংস্পর্শে থাকলে দিন দিন তা ক্ষয় হতে থাকে। বাতাসের জীলয় বাস্প এবং বিভিন্ন রাসায়নিককে প্রতিরোধের জন্য ধাতব বস্তুগুলোর উপর বিশেষ এক ধরনের পেইন্ট করা হয় যাকে ক্ষয় প্রতিরোধী পেইন্ট বলা হয়। এটি তিসির তেল, সূক্ষ্ম বালি এবং জিঙ্ক ক্রোম থেকে তৈরি করা হয়।
এই ধরনের পেইন্ট প্রধানত কালো রংয়ের হয়ে থাকে। প্রায়শই পাইপ বা অন্যান্য ধাতব পৃষ্ঠগুলোতে ক্ষয় প্রতিরোধী পেইন্ট ব্যবহৃত হয়।
প্লাস্টিক পেইন্ট প্রধানত তেল-ভিত্তিক পেইন্ট যা প্রাচীরকে একটি প্লাস্টিকের মতো চকচকে চেহারা এনে দেয়। নামেই বুঝা যায় এর ফলাফল কেমন হবে। এতে প্রচলিত ইমালসন পেইন্টের তুলনায় প্লাস্টিকের পরিমাণই বেশি রয়েছে। পেইন্টে প্লাস্টিকের পরিমাণ যত বেশি হবে, ফিনিশিং তত মসৃণ এবং সিল্কি হবে।
এই পেইন্টের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ধোয়া-মুছা কিংবা পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় এর বিশেষ কোন ক্ষতি হয় না। প্লাস্টিক পেইন্ট ম্যাট ফিনিশ, সেমি-গ্লস ফিনিশ, গ্লস ফিনিশ বা সাটিন ফিনিশই হোক না কেন, আপনি প্লাস্টিক পেইন্ট থেকে সহজেই যে কোন দাগ তুলে ফেলতে পারবেন।
১) দেয়ালে আলো ফেলে দেখে নিন:
দেয়ালে রং করা হয়ে গেলে চার্জার লাইট বা টর্চ লাইটের আলো ফেলে দেখে নিন কোনো ঢেউ, গর্ত কিংবা ফোসকা আছে কি না। আলো দেয়ালের নিচ থেকে ফেলুন, যাতে রঙের মাঝে কোনো অসামঞ্জস্য থাকলে তা বোঝা যায়।
২) রোলার ব্রাশ পরিষ্কার করে নিন:
নতুন রোলার ব্রাশের ওপর খোঁচা খোঁচা ব্রিসল বের হয়ে থাকে, লেগে থাকতে পারে ধুলো ময়লা। এটাকে শুকনো সুতি কাপড় দিয়ে মুছে নিতে পারেন অথবা এক টুকরো টেপের আঠালো অংশ ব্যবহার করতে পারেন। এতে রঙ করতে গিয়ে রংটা অমসৃণ হবে না।
৩) ওপর থেকে নিচে লম্বালম্বি রং করুন:
অনেকেই উপদেশ দেন রং করার সময় আড়াআড়ি রং করতে। কিন্তু তা না করে ওপর থেকে নিচে লম্বালম্বি টান দিয়ে রঙ করুন। এতে পুরো দেয়ালে সমানভাবে রং হবে। প্রথম কোট আড়াআড়ি টানলে পরবর্তী কোট উপর নিচে টানতে হবে।
৪) প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখুন ব্যবহার করা রোলার:
একদিনে রং করে শেষ করতে না পেরে পরের দিনের জন্য ব্রাশ ও রোলার রেখে দিলে তাতে রঙ জমে শক্ত হয়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয় যাবে। এ সমস্যা এড়াতে রোলারটাকে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে বা পলিথিনে ভরে রাখুন। এতে তা শুকিয়ে শক্ত হয়ে যাবে না।
৫) পরিমাপ মতো রং মিশ্রন করুন:
এক সাথে অধিক পরিমানে রং না মিশ্রন করাই উত্তম, দিনের রং দিনে শেষ করতে হবে। বিভিন্ন অনুপাতে একাধিক রং মিশিয়ে তৈরি করতে হলে সঠিক অনুপাতে মিশাতে হবে, না হলে এক ওয়ালের সাথে অন্য ওয়ালের রং এ অসামঞ্জস্য দেখা দিবে। হাতে মিক্সিং না করে মেশিনে মিক্সিং করাই উত্তম।
আপনি কেমন পেইন্ট করতে চান? বিষয়টি সম্পূর্ণই আপনার ব্যক্তিগত তবে অবশ্যই বাড়ির ডিজাইনের সাথে রংয়ের সামঞ্জস্য রাখা খুব জরুরি। অনেক মূল্যবান বাড়িও দেখে চোখ জুড়ায় না শুধুমাত্র রংয়ের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহারের জন্য। তাই বাড়িতে পেইন্টিং বা রংয়ের কাজ করার আগে অবশ্যই একজন দক্ষ পেইন্টারের পরামর্শ নেয়া উচিত। সর্বোপরি আপনার বাড়িটি হোক আপনার ভাবনার মতোই রঙিন।
আমি সারোয়ার আলম। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 4 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 10 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 1 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 2 টিউনারকে ফলো করি।
শুন্য থেকে যাত্রা শুরু, শুন্যেই হবে শেষ...