ফ্রিলান্সিং(মুক্তপেশা) বা আউটসোর্সিং(ইহার কোন বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়া যায় নায়, আশা করি খুব তাড়াতাড়িই পাবো বাংলা একাডেমী আছে না) শব্দদুটির যে কোন একটি শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে উঠে ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ সামনে, পাশে কফির মগ নিয়ে অল্পবয়সী কোন তরুণ বা তরুণী ইন্টারনেটে কাজ করে যাচ্ছে মনের সুখে(আমেরিকাতেও মনে হয় কেউ এমন স্বপ্নের মত ফ্রিলান্সিং করে নাহ, আর বাংলাদেশে)
ফ্রিলান্সিং বা আউটসোর্সিং বলতে সাধারণত আমরা বুঝি ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ করে টাকা আয় করা, সাধারণ অর্থে ফ্রিলান্সিং এর সঙ্গা এটাই।
Freelancing(ফ্রিলান্সিং) একটি ইংরেজী শব্দ। Free এবং Lancing দুটি আলাদা শব্দ থেকে Freelancing শব্দটির উৎপত্তি। Freelancing শব্দটির প্রথম অংশ Free শব্দটি এসেছে জার্মান ভাষা থেকে যার অর্থ To Love(ভালবাসতে/ভালবাসে), কে না ভালবাসে নিজের ইচ্ছামত সময়ে পছন্দের কাজ করে জীবিকা উপার্জন করতে? আর দ্বিতীয় অংশ Lancing এসেছে ফরাসি ভাষা থেকে যার অর্থ Hurl(সজোরে নিক্ষেপ করা)। হ্যাঁ আপনি ঠিকই পড়েছেন।
শাব্দিক অর্থ বের করতে গেলে আপনার মাথা নষ্ট না হলে আমাকে বলবেন, আপনার মত লিজেন্ডকে একবার না দেখে মরতে চাই না আমি। ফ্রিলান্সিং হল মূলত, জীবিকা নির্বাহের জন্য কারো অধীনে না থেকে নিজের ইচ্ছা ও পছন্দমত কাজ করা।
এখনকার যুগে ফ্রিলান্সিং এর ধারণা প্রধানত ইন্টারনেট থেকে মুক্ত ভাবে আয়ের উপরেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু যে কোন ধরনের স্বাধীন পেশাই ফ্রিলান্সিং এর আওতাভুক্ত। এমনকি কৃষিকাজ, লেখালেখি, স্বাধীন যে কোন ব্যবসা, মুদি দোকানদারি(নিজে মালিক হলে), ড্রাইভিং(গাড়ি নিজের হলে), খামার ও পশুপালন এই বিষয়গুলোও ফ্রিলান্সিং এর অন্তর্ভুক্ত। যারা Freelancing করে তাদের বলা হয় Freelancer(ফ্রিলান্সার), সোজা বাংলায় মুক্তপেশাজীবি।
১) Side-Project Freelancer(পার্শ্বিক মুক্তপেশাজীবি) : এরা মূলত জীবিকার জন্য দৈনিক কোন একটি পেশার সাথে সম্পৃক্ত। তাদের দৈনিক পেশার কর্মকান্ড সম্পাদন করার পর তারা ফ্রিলান্সিং করে। অর্থাৎ এরা সম্পূর্ণ মুক্তপেশাজীবি বা ফ্রিলান্সার না, আংশিক মুক্তপেশাজীবি।
২) Full Time Freelancer(সার্বক্ষণিক মুক্তপেশাজীবি): জীবিকা অর্জনের জন্য সম্পূর্ণভাবে মুক্তপেশার উপর নির্ভরশীল। এরা পছন্দানুযায়ী একের পর এক ফ্রিলান্সিং জব করতে থাকে।
৩) Single Contract Freelancer(কন্ট্রাক ভিত্তিক ফ্রিলান্সার): কন্ট্রাক নেওয়ার মাধ্যমে ফ্রিলান্সিং করে। ক্লায়েন্টের সাথে কন্ট্রাক করে কোন একটি প্রজেক্ট নেয় এবং একটি প্রজেক্টই করে। সার্বক্ষণিক ফ্রিলান্সারদের মত একের পর এক জব করে না।
৪) Freelancer Business Owner(ফ্রিলান্সিং ব্যবসার মালিক): ব্যবসার বৃদ্ধির জন্য যারা ফ্রিলান্সারদের কাছে নিজেদের সুযোগগুলি কম উপস্থাপন করে। তবে মাঝে মাঝে এরাও ফ্রিলান্স জব করে।
আধুনিক ফ্রিলান্সিং বলতে আমরা সাধারণত ইন্টারনেটে মুক্তপেশাকে বুঝলেও ফ্রিলান্সিং এর ধারণা আরো অনেক বিস্তৃত। যে কোন ধরনের মুক্তপেশাকেই ফ্রিলান্সিং এর আওতায় ফেলার ফলে এর পরিধি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফ্রিলান্সিং এর ধারণা কিন্তু মোটেও আধুনিক কোন ধারনা নয়। ১৮-১৯ শতাব্দীতে ফ্রিলান্সিং এর ধারণা পাওয়া যায়। মনে করা হয় ১৮ শতাব্দীতে ফ্রিলান্সিং ধারনার উৎপত্তি। 'Freelance' শব্দটির প্রথম ব্যবহার পাওয়া যায় Sir Walter Scott এর ১৮১৯ সালে লেখা 'Ivanhoe' বইয়ে। যেখানে একজন লর্ড(রাজা বা আধিকারিক) তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে(বেতনভুক্ত সৈন্য) বলেন,
"I offered Richard the service of my Free Lances, and he refused them—I will lead them to Hull, seize on shipping, and embark for Flanders; thanks to the bustling times, a man of action will always find employment."
(বাংলা করি দিতে ফারতাম না, নিজেরা করি লন😉😉)। কিন্তু 'Freelance' শব্দটি ইংরেজি ভাষাতে আসে ১৮০০ সালের শুরুর দিকে তখন 'Freelance' দ্বারা বোঝানো হত একদল চিকিৎসক কাম সেবিকা/সেবকদের যারা যুদ্ধের ময়দানে যে পক্ষ বেশি টাকা দত তাদের সৈন্যদেরই চিকিৎসা/সেবা করত। P.G. Wodehouse ১৯৩০ সালে তার এক প্রবন্ধে একজন ফ্রিলান্সার লেখকের উল্লেখ করেন যিনি খুবই হাসিখুশি ফ্রিলান্সার জীবনযাপন করছিলেন।
১৯৬৯ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তলার উদ্দেশ্যে ARPANET(Advance Research Project Agency Network) নামক ইন্টারনেটের প্রাথমিক ভিত্তি তৈরী করে। ১৯৯০ সালে ARPANET বন্ধ হয়ে Internet নামে চালু হয় আধুনিক ইন্টারনেট। এর আগেই অবশ্য ১৯৮৯ সাল থেকেই ISP এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জন্য ইন্টারনেট উন্মুক্ত হয়। ইন্টারনেট ইতিহাস বাদ থাক আমরা ফ্রিলান্সিং এ ফিরে আসি।
আধুনিক ফ্রিলান্সিং এর ধারণা তৈরী হয় ১৯৭২ সালে। ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া এর অধ্যাপক Jack Nillies সর্বপ্রথম আধুনিক ফ্রিলান্সিং এর ধারনা বর্ণনা করেন। ৭০ এর দশকে ইন্টারনেট সাধারণের নাগালে না থাকায় ফ্রিলান্সিং এর ধারনা তখন খুব একতা বিকশিত হয় নি। ফ্রিলান্সিং মূলত জনপ্রিয় হয়ে উঠে ১৯৯৫ থেকে, ততদিনে ইন্টারনেট সাধারণের নাগালে চলে এসেছে ফলে এর পর থেকে ফ্রিলান্সিং এর জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে।
তবে ২০০১ এর পর আমেরিকার ফ্রিলান্সিং জোয়ারে একটু ভাটা পড়ে। অনেকে এর জন্য ৯/১১ কে দায়ী করেন। আবার ২০০৫ এর পর থেকে আমেরিকান ফ্রিলান্সারদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে এবং আশা করা যায় ২০২৫ এর মধ্যে আমেরিকার জনসংখ্যার ৫০% ই ফ্রিলান্সিং এর সাথে যুক্ত হবে।
আমেরিকার ফ্রিলান্সার আর সাধারণ চাকরিজিবিদের একটা গ্রাফ দেখলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আশা করা যায় সারা বিশ্বেই এই সময়ে ফ্রিলান্সারদের সংখ্যা বাড়বে। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ এর মধ্যে বিশ্বে ফ্রিলান্সারদের সংখ্যা এখনের তুলনায় দ্বিগুণ হবে।
আনন্দের বিষয় হল বাংলাদেশে ফ্রিলান্সিং জনপ্রিয় হচ্ছে। বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে আমদের ফ্রিলান্সাররা আর দক্ষ ও অভিজ্ঞ হয়ে উঠছে। আয় করছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে এ খাত থেকে আয় বাড়ছেই। ২০১৪-১৪ অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় হয় ৭ কোটি ৩৯ লাখ ডলার পরবর্তীতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়ে যায় ৯ কোটি ৪৯ লাখ ডলার 😊😊😊। আর এটাকার পুরোটাই বৈদেশিক মুদ্রায়.
* বাংলাদেশ ১২ ঘন্টা টাইম জোনে অবস্থিত। অর্থাৎ আমেরিকা বা ইউরোপে যখন রাত আমাদের এখানে তখন দিন। অর্থাৎ ইউরোপ আমেরিকার ক্লায়েন্টদের কাজগুলো আমরা দিনে করতে পারব, যখন তারা ঘুমাবে। আবার ইচ্ছা করলে ২৪ ঘন্টাই কাজ করা সম্ভব।
* আমাদের দেশে রয়েছে প্রচুর বেকার যুবক, যারা চাকরি পাবার জন্য হণ্যে হয়ে ঘুরাঘুরি করছে. এসব বেকার যুবকদের যথাযোগ্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলে ফ্রিলান্সিং এ কর্মক্ষেত্র তৈরী করে দেওয়া সম্ভব।
* আমাদের দেশে শ্রমের মূল্য অনেক কম। কিন্তু আমাদের দেশে রয়েছে অনেক স্কিলড আর অভিজ্ঞ ফ্রিলান্সার, আবার নতুনদের ভালো প্রশিক্ষণ দিয়ে স্ক্লিওদ করে গড়ে তুললে ভালো কাজ পাওয়া সম্ভব। কেননা, ইউরোপ আমেরিকার কোন ফ্রিলান্সার কোন একটা কাজ যখন ৫০ ডলারের নিচে করে দিবে না আমাদের ফ্রিলান্সাররা সেটা ২০-২৫ ডলারের মধ্যেই করে দিবে।
ফ্রিলান্সিং এমন এক ক্ষেত্র যেখানে যে কোন বিষয়ে পারদর্ষী ব্যক্তিই কাজ করতে পারবে। কাজের ক্ষেত্র বিশাল। সারা পৃথিবী জুরে ফ্রিলান্সিং করার সুযোগ রয়েছে(নিজের ঘরে বসেই)। তারপরেও বলছি কেন ফ্রিলান্সিং;
ফ্রিলান্সিং এর প্রথম কথাই হল একজন ফ্রিলান্সার কোন একজন ক্লায়েন্টের সাথে দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নন। ক্লায়েন্ট বা কর্মদাতা তার কাজটি করিয়ে নেওয়ার জন্য একজন ফ্রিলান্সারের সাথে সাময়িক একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। সেই চুক্তির মেয়াদ থাকে কাজটি বুঝিয়ে দেবার আগে পর্যন্ত। এখন একজন এমপ্লয়ার বা ক্লায়েন্ট বা কর্মদাতা যখন তার কাজটি কোন ফ্রিলান্সারকে দিবেন তিনি অবশ্যই চাইবেন তার কাজটি দ্রুত হোক এবং যাকে দিয়ে কাজটি তিনি করাচ্ছেন তিনি যেন অভিজ্ঞ ও স্কিলড হন যাতে তার কাজটি সূক্ষ্ম ভাবে সম্পন্ন হয়।
অর্থাৎ কোন ফ্রিলান্সারের অবশ্যই দক্ষ এবং অভিজ্ঞ হওয়া খুনই জরুরি। তা না হলে কাজ পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে যাবে। সবসময়ই সেরা ফ্রিলান্সার কাজটি পেয়ে থাকেন।
ফ্রিলান্সিং এ যে কোন বিষয় নিয়েই কাজ করা সম্ভব। কোন ব্যক্তি যদি রান্নায় পারদর্শী হয় তবে সেও ফ্রিলান্সিং এর মাধ্যমে টাকা আয় করতে পারবে। সে রান্না বিষয়ক একটা সাইট খুলে বা ইউটিউব চ্যানেল খুলে তাতে নতুন নতুন এবং ভালো মানের রান্নার রেসিপি দেওয়ার মাধ্যমে ভাল আয় করতে পারবে। মুল কথা হল দক্ষতা থাকতে হবে। দক্ষতা থাকলে ফ্রিলান্সিং এ সফলতা আসবেই। তাই আজই আপনি কোন একটি বিষয় নিয়ে সর্বোচ্চ ধারণা নিয়ে নিন আর শিখে নিন, হয়ে উঠুন দক্ষ।
এমন কিছুসাইট; shutterstock.com, fotolia.com, istockphoto.com, dreamstime.com। আনার বিভিন্ন কনটেস্টে অংশ নিয়েও আয় করতে পারেন। গ্রাফিক্স ডিজাইনিং এর উপরেই হবে কনটেস্ট।
এমন কিছু সাইট: 99designs.com, logotournament.com, designbyhuman.com।
এমন কিছু সাইট: themeforest.net, graphicriver.com, 3docean.net, photodune.net ইত্যাদি।
আমার চ্যানেল
আপনার ফ্রিলান্সিং জীবন সুন্দর হোক!
আমি হাসিবুর ইসলাম নাসিফ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 9 বছর 6 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 43 টি টিউন ও 76 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 3 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
বিষাদময় পৃথিবীতে আমি আনন্দ খুঁজে নিই সবকিছু থেকে। আর স্বপ্ন দেখি মহাকাশ ভেদ করে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেবার। স্বপ্নচারী আমার স্বপ্নগুলোই বাঁচিয়ে রেখেছে আমাকে। হাত ধরে চলো স্বপ্ন দেখি একসাথে।