কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে আউটসোর্সিংয়ের কাজে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে এবং তারা আন্তজার্তিকভাবে ব্যাপক সুনামও অর্জন করেছে। এ মূহুর্তে প্রায় ৫০-৬০ হাজার তরুণ অনলাইনের ইনকামে যুক্ত রয়েছে সক্রিয়ভাবে। আরও প্রচুর বাংলাদেশী নাগরিককে অনলাইন ইনকামে যুক্ত হতে উৎসাহিত করার জন্য ২০১১ সাল থেকে আউটসোর্সিং পুরস্কার দিচ্ছে সফটওয়্যার খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)। চলতি বছরের পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ১৩ এপ্রিল। পুরস্কার পাওয়া কয়েকজন সফল ফ্রিল্যান্সারদের গল্প সবার সাথে শেয়ার করব, যাতে নতুন যারা তারা কিছু দিক নির্দেশনা পেয়ে থাকে।
চট্টগ্রামের মেয়ে সুলতানা পারভীন, আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছেন ২বছর ধরে। নিয়মিত পত্রপত্রিকা এবং বাংলা ব্লগে আউটসোর্সিংয়ের লেখা পড়ে অনলাইনে ক্যারিয়ার গড়ার ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি হয়। সেই আগ্রহ থেকেই স্থানীয় বিকন আইটি নামের একটি প্রতিষ্ঠানে সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের (এসইও) উপর ট্রেনিং নিয়ে আউটসোর্সিংয়ের কাজ শুরু করে ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে। এরপর এ কাজ বাদ দিয়ে বর্তমানে রেসিপি, ব্লগ লেখার কাজ করছেন। বিভিন্ন বায়ারের চাহিদা অনুযায়ি ব্লগে লিখেন নিয়মিত। আর এ কাজ করেই প্রতি মাসে তার আয় হয়, ৪০ হাজার টাকার মত। অ্যামাজন থেকে তার একটি ই-বুকও বের হয়েছে। দুই ছেলেমেয়েকে লালন পালন এবং স্বামীর সেবা করার পাশাপাশি এ কাজ করতে পেরে তিনি অনেক সুখী। তার মতে, আউটসোর্সিং করার জন্য ইংরেজী এবং যে বিষয়ের উপর কাজ করতে আগ্রহী সেটির উপর দক্ষতা অর্জনের অভিজ্ঞদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তারপর কাজ শুরু করা উচিত।
রাঙামাটির মত প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেই ২০১১ সাল থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করছেন প্রতুল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা। hubpage.com এ ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কিত বিষয়ে অনুচ্ছেদ লেখার মাধ্যমে শুরু। বর্তমানে ওডেস্ক, ফ্রিল্যান্সার এবং ইল্যান্সের বিভিন্ন বায়ার এর জন্য ওয়েব বিপননের কাজ করছেন। শুধু নিজেই কাজ করে থেমে থাকেননি। গ্রামের অনেককে এ কাজে অনুপ্রাণিত করেছেন এবং তাদেরকে নিয়ে গ্রুপ তৈরি করে কাজ করছেন। তার মাসিক আয় গড়ে ৩৮ হাজার টাকা। ধীরগতির ইন্টারনেট সংযোগের কারণে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয় নিয়মিত। তার মতে, ইন্টারনেট সংযোগ সুবিধা ভাল হলে আরও অনেকে রাঙ্গামাটিতে থেকেই ফ্রিল্যান্সিংয়ে ভাল কাজ করতে পারবে।
আইফোনের অ্যাপলিকেশন (অ্যাপ) ডেভেলপার হিসেবে কাজ করেন তাসনিম আলম। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর মাধ্যমে ক্যারিয়ার শুরু করলেও ২০১১ সাল থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে এ কাজ করছেন। জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস ওডেস্ক থেকে পাচ্ছেন এসব কাজ। কাজ বেড়ে যাওয়ার কারনে এখন গ্রুপ তৈরি করেছেন। এ গ্রুপে আছেন ডিজাইনার এবং প্রোগ্রামার। তার মাসিক আয় দুই লাখ টাকার বেশি। তার মতে সততা এবং নিয়মানুবর্তিতা থাকলে অবশ্যই সকল কাজে সফলতা অর্জন করা যায়।
এ বছর এসইও ও অনলাইন বিপণন বিভাগে সেরা নির্বাচিত হয়েছেন আনিসুল ইসলাম। খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশলে স্নাতক পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশানি করতেন। ২০১০ সাল থেকে এসইও সম্পর্কিত কাজ শুরু করেন। এরপর মাঝে ২০১২ সালের জুলাইয়ে ঢাকাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করলেও ১বছর পরেই সেটি ছেড়ে দিয়ে ফরচুন টেক নামে একটি আউটসোর্সিং কোম্পানি চালু করেন। বর্তমানে সেই কোম্পানীর মাসিক আয় পাঁচ হাজার ডলার। তিনি নতুনদের উদ্দেশ্যে বলেন, আউটসোর্সিংয়ের সফল হতে হলে অবশ্যই ধৈর্য শক্তি থাকতে হবে এবং সেই সাথে যে বিষয়ের উপর কাজ করবেন, তার উপর দক্ষতা থাকতে হবে।
শামসুল আলম পেশায় একজন ব্যাংকার, পাশাপাশি করতেন শেয়ার ব্যবসা। ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ২৫ লাখ টাকা লোকসান হয় তাঁর। এ ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতেই তার আউটসোর্সিং এর জগতে পা রাখা। ২০১১ সাল থেকে শুরু করে আড়াই বছর ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ডাটা এন্ট্রি ও ওয়েবরিসার্চের কাজ করেন। এ আড়াই বছরে শেয়ার ব্যবসার জন্য নেওয়া ব্যাংক ঋণের প্রায় পুরোটাই শোধ করেছেন । বর্তমানে তিনি ‘ওয়েফটি’ নামে একটি আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, যেখানে কাজ করছে ৭জন তরুণ। তার প্রতি মাসে আয় দুই লাখ টাকারও বেশি। তার মতে ফ্রিল্যান্সিং হচ্ছে অনলাইন উদ্যোক্তা হওয়ার একটি বিশাল ক্ষেত্র।
আব্দুর রাজ্জাক বগুড়াতে বসে ২০১২ সাল থেকে শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিং। তার কাজের সেক্টর হচ্ছে গ্রাফিকস। envato.com এ তার ডিজাইন বিক্রি করেই প্রতি মাসে আয় করছেন, সাত লাখ টাকার বেশি। আর এজন্য তাতে প্রতিদিন আট ঘন্টার মত কাজ করতে হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকাতে এসে কম্পিউটার গ্রাফিকস প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময় এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে আউটসোর্সিংয়ের কথা তার কানে আসে। তারপর থেকে চেষ্টা শুরু। আর এখন সফল বলা যায়। উনি নিজে কাজ করার পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে বগুড়ায় তরুণদের ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তার মতে, বাংলাদেশে পেপ্যাল ব্যবহারের সুবিধা থাকলে নিজের ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই কাজ করার সুবিধা থাকত, আর তাতে আয় আরো বেশি করা সম্ভব হত।
ঢাকা মিরপুর বাঙলা কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে পড়ছেন মাহফুজা সেলিম। ভাল লাগা থেকেই কম্পিউটার গ্রাফিকসের উপর কোর্স করেন। তারপর এক বান্ধবীর পরামর্শে ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ওডেস্কে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে প্রচুর কাজ পাচ্ছেন। বর্তমানে তার মাসিক আয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।
Freelancer.com এ ২০০৭ সাল হতে ওয়েবডিজাইনার হিসেবে আউটসোর্সিংয়ের কাজ শুরু করেন নূর মোহাম্মদ। প্রথমে একা শুরু করলেও বর্তমানে তার গ্রুপের সদস্য ১৫ জন। প্রতি মাসে গড়ে আয় করছেন, এক লাখ টাকা। তার মতে, প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা আউটসোর্সিংয়ের কাজে খুব একটা কাজে আসেনা। তিনি নিজে নিজেই সকল কাজ শিখেছেন। আর একাজে উনি অনলাইনে বিভিন্ন বিষয়সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও টিউটোরিয়ালের সহযোগিতা নিয়েছেন। অনলাইনে অনেক ডিজাইন কমিউনিটি আছে, যাদের করা নানা রকম ডিজাইন তাকে এই কাজে আসতে উৎসাহিত করেছে।
ইয়াসির আরাফাত দুই বছর ধরে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছেন ওডেস্ক ও ইল্যান্সে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘মিডাস জেড-টেকনোলজি’ ফ্রিল্যান্সিং প্রতিষ্ঠানে আছে তার অংশীদারত্ব। মূলত প্রোগ্রামিং এবং ওয়েব ডেভেলপমেন্টের কাজই বেশি করেন। তার প্রতি মাসে আয় চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। স্বাধীনভাবে কাজ করার সুবিধার কারনে চাকুরী করার চাইতে ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজেই তার আগ্রহ বেশি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ভবিষ্যৎ আনেক ভালো বলে তাঁর ধারণা। এ ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন আছে, মনে করেন তিনি।
সায়েমা মুহিত ২০১১ সালে ঢাকা সিটি কলেজে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক পড়ার সময় পড়াশোনার পাশাপাশি আউটসোর্সিংয়ের কাজ শুরু করেন। তার কাজের ক্ষেত্র সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (এসইও)। তার স্বামী মহিউদ্দিন মুহিতও গত বছর বেসিস পুরস্কার পেয়েছেন। সংসারের ব্যস্ততার পাশাপাশি আউটসোর্সিং করেন। সায়েমার প্রতি মাসে আয় এক লাখ টাকার বেশি। তার মতে, মেয়েদের সংসার ফেলে বাইরে চাকুরী করার চাইতে ঘরে বসে আউটসোর্সিং করা অনেক ভাল। সংসারও দেখা হবে, ভাল আয়ও করা যাবে।
৩৮ বছর বয়সী মহানন্দ সরকার চাকরির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শুরু করেন। পরে চার হাজার ডলারের একটা বড় কাজ পেয়ে যান। কয়েকজন তরুণকে নিজের হাতে প্রশিক্ষণ কাজের উপযোগী করে গড়ে তোলে সবাই মিলে শেষ করেন প্রকল্পটি। চাকুরী ছেড়ে দিয়ে দুই বছর ধরে ইল্যান্স ও সরাসরি বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করছেন। গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজই বেশি করেন। প্রতি মাসে আয় এক লাখ টাকা। তারমতে যেকোন পেশার লোক নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করতে পারেন। তার জন্য অবশ্যই ইংরেজি ভালভাবে জানা থাকতে হবে।
২০১১ সাল থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করছেন শাকিল হোসাইন। তিনি এবার ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে পুরস্কার পেয়েছেন । প্রতি মাসে আয় ৩০ হাজার টাকার মতো। মাইক্রো ওয়ার্কস এবং ওডেক্সের মাধ্যমে ওয়েব ডেভেলপমেন্টের কাজ করেন তিনি।
শাকিল আগে চাকরি করতেন একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে। স্বাধীনভাবে কাজ করার আশাতে চাকরি ছেড়ে শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিং। তিনি জানালেন, ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে কাজটা বুঝে নেওয়া এবং বুঝিয়ে দেওয়াই বড় একটা ব্যাপার। বড়জোর ছয় মাস কিংবা এক বছর লাগে এই কাজটি রপ্ত করতে।
ক্যারিয়ারে শুরুতে শিক্ষকতা করলেও একসময় তা ছেড়ে আউটসোর্সিংয়ের কাজ শুরু করেছেন আবু সালেহ মো. কায়সার। কাজ করছেন প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেল। মুঠোফোনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কল ও এসএমএস ব্লক করার একটি অ্যাপ তৈরি করেছেন তিনি। ছেড়ে দিয়েছেন অনলাইন বাজারে। ইউরোপের কয়েকটি দেশে এ অ্যাপ জনপ্রিয়। কল অ্যান্ড এসএমএস ব্লকার প্রো নামের এ অ্যাপ থেকে কায়সারের আয় হয় মাসে প্রায় পৌনে দুই লাখ টাকা। তিনি বলেন, এই কাজের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করা যায়। কাজটা করার জন্য একটু দক্ষ হতে হবে, তবেই আসবে সফলতা।
পোস্টটি সবারই নিজেদের ফেসবুকে শেয়ার করা উচিত, তাহলে নতুন নতুন ফ্রিল্যান্সার তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা আরো বাড়বে।
ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কিত সহযোগিতার জন্য ফেসবুক গ্রুপঃ facebook.com/groups/creativeit/
আমার ব্লগ থেকে ঘুরে আসতে পারেন। লিখতেও পারেন এবং পড়ার জন্য পাবেনও অনেক কিছু।
ব্লগ লিংকঃ জেনেসিস ব্লগ
আমি মোঃ ইকরাম। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 5 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 102 টি টিউন ও 130 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 4 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
নিজেকে অনলাইন ব্রান্ড এক্সপার্ট হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করলেও গ্রাফিকস, ওয়েবডিজাইন এবং অ্যানিমেশন বিষয়েও প্রচুর কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। লার্নিং এন্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। ব্লগিংটা নেশার কারনে করি। নিজের ব্লগের লিংকঃ http://genesisblogs.com/
আগ্রহ আরও একটু বেড়ে গেল।