আকাশ থেকে সর্বদা এক অক্লান্ত চোখে আমাদের প্রত্যেকটি কর্মকাণ্ডের উপর নজর রাখা, এমন এক কম্পাস সুবিধা যাতে পৃথিবীর যেকোনো স্থান খুঁজে পাওয়া, যেকোনো রেডিও সিগন্যাল প্রতিফলিত করে আবার পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়া—এই তিনটি প্রধান কাজ স্যাটেলাইট আমাদের জন্য করে থাকে। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে এই শতশত স্যাটেলাইট গুলোকে হয়তো খালি চোখে দেখতে পাবেন না, কিন্তু টিভি ব্রডকাস্ট থেকে শুরু করে আন্তর্মহাদেশীয় টেলিফোন কল, আবহাওয়া বার্তা এবং স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিচালনা করতে স্যাটেলাইট গুলো দিনরাত কাজ করেই চলছে। আজকের টিউনে স্যাটেলাইটের অন্যান্য কাজ গুলো নিয়ে আলোচনা করবো না, আজ জানবো স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সম্পর্কে—এটি কীভাবে কাজ করে, এটি কতটা উপযোগী, এর সুবিধা অসুবিধা ইত্যাদি সম্পর্কে।
স্যাটেলাইট মানেই যে কোন রকেট হবে আর তাতে এক গাঁদা যন্ত্রপাতি বসানো থাকবে, এমনটা কিন্তু নয়। স্যাটেলাইটের সাধারন অর্থ এর চেয়েও সাধারন—একটি ছোট স্পেস অবজেক্ট যদি কোন বড় অবজেক্টকে কেন্দ্রকে লাগাতার কোন কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে তবে সেটিকে স্যাটেলাইট বলা হয়। যেমন চাঁদ হলো পৃথিবীর প্রকৃত স্যাটেলাইট বা উপগ্রহ, কারন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একে পৃথিবীর চারপাশে প্রদক্ষিণ করতে বাধ্য করে রেখেছে। আকাশে রকেটে করে ছেঁড়ে দেওয়া স্যাটেলাইট, যেগুলোকে আমরা প্রকৃত স্যাটেলাইট হিসেবে চিনি, সেগুলো আসলে আর্টিফিশিয়াল (মানুষের তৈরি) স্যাটেলাইট বা কৃত্তিম উপগ্রহ, এবং এগুলো একটি গননা করা পথে অবিরত প্রদক্ষিন করে। এটি বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার পথে এবং পৃথিবী থেকে বিভিন্ন দূরত্বে প্রদক্ষিন করতে পারে। সাধারনত এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপরে অবস্থিত থাকে।
মহাকাশে আমাদের স্যাটেলাইট ছেঁড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগলিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানা—এটি আমাদের এই পৃথিবীর উপর থেকে পৃথিবীর দিকে নজর রাখতে সাহায্য করেছে, এর ফলে আমরা জীবনের বৃত্তান্ত সম্পর্কে জেনেছি। মহাকাশে বিভিন্ন প্রকারের স্যাটেলাইট ছেঁড়ে দেওয়া রয়েছে। এদের কোন কোন গুলো আবহাওয়া তথ্য সরবরাহ করে, কোন গুলো ন্যাভিগেশন যেমন জিপিএস ডাটা সরবরাহ করে আবার কোন গুলো কমুনিকেশনের জন্য ব্যবহৃত হয়। স্যাটেলাইট ফোন কল বা স্যাটেলাইট ইন্টারনেট, কমুনিকেশন স্যাটেলাইটের বদৌলতে সম্ভব হয়ে থাকে। কমুনিকেশন স্যাটেলাইট অনেকটা আয়না বা দর্পণের মতো কাজ করে—এটি পৃথিবী থেকে আসা সিগন্যালকে প্রতিফলিত করে আবার পৃথিবীতেই পাঠিয়ে দেয়। মনেকরুন আপনি গভীর জঙ্গল বা পাহাড়ি এলাকা থেকে ফোন করতে চান, সেখানে অবশ্যই সাধারন ফোন কাজ করবে না, কেনোনা সেলফোন টাওয়ার সিগন্যাল পাওয়া যাবে না—আপনি স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার করে কল করতে পারেন। এতে আপনার ফোন থেকে একটি সিগন্যাল কমুনিকেশন স্যাটেলাইটের কাছে যাবে এবং সেই সিগন্যাল প্রতিফলিত হয়ে এর গন্তব্যে মানে পৃথিবীতে ফিরে আসবে।
কমুনিকেশন স্যাটেলাইট ব্যবহার করে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে রেডিও সিগন্যালকে পাঠানো হয়। আর স্যাটেলাইট ইন্টারনেট অনেকটা এভাবেই কাজ করে। পৃথিবীর কোন এক প্রান্ত থেকে কোন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার ইন্টারনেট ডিজিটাল রেডিও সিগন্যালকে স্যাটেলাইটের দিকে ছুড়ে মারে (স্যাটেলাইট ডিশ এন্টেনা থেকে), সেই সিগন্যালকে স্যাটেলাইট গ্রহন করে এবং সিগন্যালকে আরো শক্তিশালি বানিয়ে আবার পৃথিবীর দিকে ছুড়ে মারে, এবার দ্বিতীয় ডিশ এন্টেনা সেই সিগন্যাল গ্রহন করে এবং আপনি ইন্টারনেট উপভোগ করতে পারেন। স্যাটেলাইট রেডিও সিগন্যালে প্রায় যেকোনো ধরনের তথ্য আদান প্রদান করানো সম্ভব, যেমন ইন্টারনেট সিগন্যাল, সেলফোন কল, টিভি ব্রডকাস্ট সিগন্যাল, রেডিও ব্রডকাস্ট সিগন্যাল ইত্যাদি।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট এবং ল্যান্ডলাইন ইন্টারনেট বা মোবাইল ইন্টারনেটের মধ্যে খুব একটা বেশি পার্থক্য নেই। ল্যান্ডলাইন ইন্টারনেট বা ব্রডব্যান্ড কানেকশনে আপনার ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডারের কাছ থেকে একটি তার এসে সরাসরি আপনার রাউটার বা কম্পিউটারে সংযুক্ত হয়। এই তারটি সাধারনত পুরাতন কপার বা অপটিক্যাল ফাইবারের হয়ে থাকে—যা সচরাচর আপনার ইন্টারনেট ডাটা বা ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করে থাকে। আবার মোবাইল ব্রডব্যান্ডে ইন্টারনেট সিগন্যালকে সেলফোন টাওয়ারের মাধ্যমে আপনার ফোনে বা মডেমে পৌছিয়ে দেওয়া হয়, এবং প্যাকেট সুইচিং পদ্ধতিতে ইন্টারনেট ডাটা সরবরাহ করানো হয়।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট এর ক্ষেত্রেও কোন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার থাকার প্রয়োজন পড়ে, তারা ইন্টারনেট সিগন্যালকে ডিশ এন্টেনা বা স্যাটেলাইট এন্টেনার সাহায্যে স্যাটেলাইটে পৌছিয়ে দেয় এবং সেই সিগন্যাল স্যাটেলাইট থেকে প্রতিফলিত হয়ে আপনার বাড়িতে লাগানো ডিশ এন্টেনাতে রিসিভ হয় এবং এই সম্পূর্ণ প্রসেসটি আলোর গতিতে সম্পূর্ণ হয়।
এখানে একটি জিনিষ মাথায় রাখা প্রয়োজনীয় যে, অনেকে মনে করেন স্যাটেলাইট টিভি সিগন্যাল থেকে ইন্টারনেট পাওয়া সম্ভব এবং এতে কোন বাড়তি খরচের প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ, টেকনিক্যালি এটি সম্ভব, তবে এতে প্রপার হার্ডওয়্যার এবং ডিভাইজের প্রয়োজন, তাছাড়া আপনার ডিশ প্রভাইডার যেকোনো সময় আপনাকে ব্যান করতে পারে। তবে প্রপারলি স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ব্যবহার করতে আপনাকে অবশ্যই কোন স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রভাইডারের কাছ থেকে সেবা নিতে হবে, কারন এই ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য পরিপূর্ণ সিস্টেম সেটআপ থাকা প্রয়োজনীয়। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সম্পূর্ণ করতে ৩টি স্যাটেলাইট ডিশ এন্টেনার প্রয়োজন পড়ে—একটিকে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার ব্যবহার করে সিগন্যাল পাঠায় (এটিকে প্রভাইডার হাব বলা হয়), আরেকটি স্পেসে থাকে এবং সর্বশেষটি আপনার বাড়িতে লাগানো থাকে যা সিগন্যাল রিসিভ করে।
আগেই বলেছি, ইন্টারনেট ডাটা সহ টিভি, কল ইত্যাদি যেকোনো রেডিও সিগন্যালকে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব। স্যাটেলাইট ব্যবহার করে আপনি যেকোনো রেডিও সিগন্যাল পাঠাতে চান না কেন, এতে তিনটি স্টেপ সম্পূর্ণ করার প্রয়োজন হয়। প্রথমত কাজ করে আপলিঙ্ক, এটি পৃথিবীতে অবস্থিত সার্ভিস প্রভাইডারের ডিশ এন্টেনা থেকে ইন্টারনেট সিগন্যাল স্যাটেলাইটের দিকে ছুড়ে মারে, পরবর্তীতে এই সিগন্যালকে স্যাটেলাইট রিসিভ করে এবং রেডিও রিসিভার, এমপ্লিফায়ার, এবং ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে প্রসেসিং করে। এই প্রসেসিং এর মাধ্যমে সিগন্যালটির শক্তি বৃদ্ধি করানো হয় এবং এর ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তন করে দেওয়া হয়—যাতে স্যাটেলাইটে রিসিভ হওয়া সিগন্যাল এবং স্যাটেলাইট থেকে পাঠানো সিগন্যালের মধ্যে গণ্ডগোল না পাকিয়ে যায়। একটি স্যাটেলাইটে অনেক রেডিও রিসিভার, এমপ্লিফায়ার, এবং ট্রান্সমিটার লাগানো থাকে, যাতে এটি একসাথে অনেক সার্ভিস প্রভাইডার থেকে সিগন্যাল রিসিভ করতে পারে এবং তা একই সময়ে অনেক সিগন্যাল পৃথিবীতে ফেরত পাঠাতে পারে।
এবং পরিশেষে থাকে ডাউনলিঙ্ক, যা পৃথিবীর বুকে অবস্থিত আরেকটি স্যাটেলাইট ডিশ এন্টেনা, সাধারনত আপনার বাড়িতে লাগানো থাকে। একটি আপলিঙ্কের পেছনে মিলিয়ন ডাউনলিঙ্ক থাকতে পারে। যেমন— একটি স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডারের যদি ১ মিলিয়ন গ্রাহক থাকে তবে এখানে একটি আপলিঙ্ক থেকে ১ মিলিয়ন ডাউনলিঙ্ক থাকবে। স্যাটেলাইট মূলত আপলিঙ্ক থেকে ডাউনলিঙ্কে লাগাতার ডাটা সরবরাহ করেই চলে। আপনার স্যাটেলাইট ডিশের সাথে কিছু ক্যাবল, রাউটার বা মোডেম লাগিয়ে রিসিভ হওয়া সিগন্যাল থেকে প্রপার ইন্টারনেট পাওয়া সম্ভব হয়।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ব্যবহার করার একমাত্র কারন হতে পারে, যদি আপনি এমন কোন স্থানে বাস করেন যেখানে ক্যাবল বা ডিএসএল নির্ভর ব্রডব্যান্ড বা মোবাইল ব্রডব্যান্ড লভ্য নয়। যদি আপনার গ্রাম থেকে ২জি ইন্টারনেট চালাতে হয়, তবে আপনার জন্য স্যাটেলাইট ইন্টারনেট আদর্শ হতে পারে, কারন এটি অনেক দ্রুতগতির হয়ে থাকে।
আসলে এটুকুতেই স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করার কারন সম্পর্কে জানা সম্ভব হবে না, চলুন এটি ব্যবহারের সুবিধা এবং অসুবিধা সমূহ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক…
গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করলে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট আপনার জন্য সুবিধা জনক হতে পারে, কিন্তু এর সুবিধার চেয়ে অসুবিধায় বেশি। বিশেষকরে এর মূল্য একদম আকাশ ছোঁয়া। যাদের যে কোন স্থানে হাই ব্যান্ডউইথ এর প্রয়োজন পড়ে (যেমন টিভি রিপোর্টারদের) তারা স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। আমার মতে এই ইন্টারনেট ঠিক তখনই ব্যবহার করা উচিৎ, যখন আপনার কাছে সত্যিই আর কোন অপশন থাকবে না।
আশা করছি আজকের টিউনটি পড়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে অবগত হতে পেড়েছেন। তো আপনি কি কখনো স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করেছেন, বা ব্যবহার করতে ইচ্ছুক? নিচে টিউমেন্টে আপনার মতামত আমাদের সাথে শেয়ার করুন।
সম্পূর্ণ ক্রেডিট- Techubs.Net
আমি তাহমিদ বোরহান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 10 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 177 টি টিউন ও 680 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 43 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।
আমি তাহমিদ বোরহান। টেক নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকতে ভালোবাসি। টেকটিউন্স সহ নিজের কিছু টেক ব্লগ লিখি। TecHubs ব্লগ এবং TecHubs TV ইউটিউব চ্যানেল হলো আমার প্যাশন, তাই এখানে কিছু অসাধারণ করারই চেষ্টা করি!
টিউনটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন এবং নির্বাচিতটিউন মনোনয়ন করুন।
যেকোনো প্রশ্নে কমেন্ট করুন এবং দয়াকরে কমেন্টে স্প্যাম করবেন না।
ধন্যবাদ 🙂