শুধুমাত্র মনের সুখ দু:খ গুলো শেয়ার করার জন্যই বন্ধুত্ব নয়, বন্ধুর প্রয়োজন সব ক্ষেত্রেই। নিজের উদ্যোগের অন্যের বন্ধুত্ব সম্পর্ক ছাড়া বড় কোন সাফল্য আসা করা যায়না। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, বিশ্বের বড় বড় সব প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের গড়ে ওঠার পেছনে উদ্যোক্তার বন্ধুদের অবদানই সবচেয়ে বেশি। কোন কোন প্রতিষ্ঠান তো কয়েকজন বন্ধুর হাতেই গড়ে উঠেছে। বিশ্ব বন্ধু দিবস উপলক্ষ্যে প্রযুক্তিক্ষেত্রের সবচেয়ে সফল সেইসব বন্ধুদের সাফল্য গাথা জানাবো আজ...
২০০৪ সাল। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ছেন বাংলাদেশী গবেষকের পুত্র জাভেদ করিম। ছাত্রাবস্থায়ই যোগ দিলেন অনলাইন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান পেপালে। চাকরিটা একবারে মন্দ ছিলনা। তবু লেখাপড়া বাদ দিয়ে করা এ চাকরিটা মেটাতে পারলনা তার উদ্ভাবনী মনের তৃষ্ণা। খুঁজছিলেন এর একটা বিকল্প পথ। কিভাবে নতুন কিছু করা যায়। পেপালে তার ঘনিষ্ট বন্ধু চাদ হার্লি এবং স্টিভ চেনের সাথেও মাঝে মাঝে শেয়ার করতেন তার মনের কথা। স্টিভও কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র। আর চাদ হার্লি পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাইন বিভাগের। জাভেদের পরিকল্পনার সাথে যুক্ত হলেন স্টিভ এবং চেন। একসাথে নিজেদের পরিকল্পনাকে এগিয়ে নেয়ার পণ করলেন। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে সান ফ্রান্সিকোতে স্টিভ চেনের বাসায় নৈশ ভোজের দাওয়াত পড়লো অপর দুই বন্ধুর। সেখানেই সিদ্ধান্ত হলো ইউটিউব সাইটটি তৈরী করার। অনলাইনে প্রচুর সাইট থাকলেও ভিডিও শেয়ার করার মত কোন উল্লেখযোগ্য সাইট তখনও নেই। ভিডিও শেয়ারিং সাইটের সম্ভাবনা যাচাই করে তাই এধরণের একটি সাইটই বানানোর সিদ্ধান্ত হলো সেদিনের সেই নৈশভোজ অনুষ্ঠানে। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারীর ১৪ তারিখে ইউটিউব ডটকম নামে ডোমেইন নিবন্ধন করলেন তিন বন্ধু। ডোমেইন নাম নিবন্ধনের পর তরুন এ তিন প্রকৌশলী হাত লাগালেন সাইটটির ডিজাইনের কাজে। কয়েকমাসের চেষ্টায় দাড়িয়ে গেল সুন্দর সাইট ডিজাইন। একই বছরের ২৩ এপ্রিলে ‘মি এট জু’ নামক প্রথম ভিডিও টি আপলোড করেন জাভেদ করিম নিজে। একই বছর মে মাসে সাইটটির পরীক্ষামূলক সংস্করন উন্মুক্ত করলেন তারা। এরপর ভেনচার ক্যাপিটালিস্টদের বিনিয়োগে বৃহত আকারে যাত্র শুরু হয় ইউটিউবের। ইউটিউব সাইটটি একই বছরের নভেম্বরে যাত্রা শুরু করেছিল। তিন বন্ধুর তৈরি এ সাইটটি সার্চ ইঞ্জিন প্রতিষ্ঠান গুগল কিনেছিল ১৬৫ কোটি ডলারে। বর্তমানে গুগলের মালিকানাধীন এ সাইটে প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী একশ কোটিবারেরও বেশিবার ভিজিট হচ্ছে।
গুরুত্বপূর্ণ কোন তথ্য খোঁজার জন্য হাজার হাজার পৃষ্ঠার বই ঘাটাঘাটির দিন অনেক আগেই শেষ হয়েছে। মাউকের কিকেই মুহুর্তে এখন খুঁজে বের করা যায় কাংখিত যেকোন তথ্য। আর এ সবই সম্ভব হয় কেবল ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিনের কল্যানে। বৈশ্বিক সার্চ ইঞ্জিন বাজারের ৭০ শতাংশের মালিক এখন যে প্রতিষ্ঠানটি সেটি হলো গুগল। ১৯৯৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সার্জিও ব্রিন ও ল্যারি পেইজ নামের দুই বন্ধু তৈরি করেছিলেন এ সার্চ ইঞ্জিনটি। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএচডি অধ্যয়ন করার সময় ঘনিষ্ট হন এই দুই বন্ধু। ‘বেকরাব’ নামক একটি গবেষনা কাজ করার সময় তারা সার্চ ইঞ্জিন তৈরির পরিকল্পনা করেন। সার্জিও ব্রিনের বাবা ছিলেন গনিতের অধ্যাপক এবং তার মা ছিলেন নাসার গবেষক। শিতি বাবা মায়ের সন্তান হিসাবে প্রযুক্তির সঙ্গে তার পরিচয় অনেক ছোটবেলায়ই। ব্রিনের বন্ধু ল্যারি পেইজের বাবা ছিলেন কম্পিউটার বিজ্ঞানী। সে সুবাদে তারও কম্পিউটারের সাথে পরিচয় ছোটবেলাতেই। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন বড় কম্পিউটার বিজ্ঞাণী হওয়ার। বড় কিছু করার। তাঁর সে স্বপ্ন পূরণের ১৯৯৫ সালের দিকে সঙ্গী হিসাবে পেয়ে যান বন্ধু ব্রিনকে। শুরুতে অল্প কিছু সাইটের অন্তভূক্তি নিয়ে তারা একটি সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করেন। এ সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে তখন কেবল নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে তথ্য খোঁজা যেত। এ সার্চ ইঞ্জিনের বৃহৎ আকারই আজকের গুগল! ভাড়া করা গ্যারেজে গুগলের কার্যক্রম শুরু হলেও এখন মাউন্টেন ভিউতে রয়েছে গুগলের নিজস্ব বিশাল আকৃতির অফিস। আর বৈশ্বিক সার্চ ইঞ্জিনের প্রায় ৭০ ভাগ বর্তমানে রয়েছে গুগলের দখলে। সার্চ ইঞ্জিন ছাড়াও গুগল ওয়েবমেইল সেবা জিমেইল, ইনস্ট্যান্ট মেসেঞ্জার এবং ভিডিও চ্যাটিং সেবা গুগল টক, বিনামূল্যের ব্লগিং সাইট তৈরির সেবা ব্লগার ডটকম, ক্যালেন্ডার এবং ইভেন্ট রিমাইন্ডার সেবা গুগল ক্যালেন্ডার, ইন্টারনেট ব্রাউজার এবং পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম ক্রোম, ম্যাপিং সেবা গুগল আর্থ, আরএসএস পড়ার সুবিধা গুগল রিডার, ছবি ব্যবস্থাপণা এবং শেয়ারিং সুবিধা পিকাসা, স্বল্পমাত্রার সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার সুবিধা গুগল বাজ, বিজ্ঞাপণ প্রোগ্রাম অ্যাডসেন্স, ভিডিও শেয়ারিং সাইট ইউটিউব, অনলাইনে লেখালেখির সুবিধা গুগল ডকস এবং সামাজিক যোগাযোগ সেবা অরকুট সহ বেশ কিছু সেবা প্রদান করে থাকে। দুইবন্ধুর তৈরি গুগলের ২০০৯ সালেরই মোট আয় ছিল ২ হাজার ৩৬৫ কোটি ডলার!
১৯৯৪ সালের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের দুই শিক্ষর্থী দুই বন্ধু ডেভিড ফিলো এবং জেরী ইয়াং সারাক্ষন পড়ে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় কম্পিউটার ল্যাবে। সেখানে তাদের বিশেষ আকর্ষন ছিল ইন্টারনেট। দুজনেরই এক অদ্ভুদ খেয়াল। সারক্ষন ইন্টারনেট বিশ্বে তথ্য খোঁজাই তাদের নেশা। কিন্তু তৎকালীন সময়ের ওয়েবসাইটগুলো থেকে তথ্য খুঁজে পাওয়াটা এত সহজ ছিলনা। এ কারনে প্রচুর ঝামেলাই পোহাতে হত ডেভিড আর জেরীকে। এ ঝামেলা থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিলেন তারা। ভেবে চিন্তে ঠিক করলেন নিজেরাই তৈরী করবেন সার্চ ইনজিন! ব্যাপারটি এত সহজ ছিলনা। নিজেদেরই তখন সার্চ ইঞ্জিনে যুক্ত করতে হচ্ছিল ওয়েবসাইটের ঠিকানা। একসময় তৈরী করে ফেললেন ‘জেরী এন্ড ডেভিডস গাইড টু দ্যা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব।’ একই বছরের এপ্রিলে নামটি পরিবর্তিত হলো ‘ইয়েট এনাদার হায়ারার্কিকাল অফিসিয়াস ওরাকল’ বা সংক্ষেপে ইয়াহু! ইয়াংয়ের এক ছাত্রের বাসার কম্পিউটার টার্মিনালে চলতে থাকলো ইয়াহু উন্নয়নের কাজ। চালু করার কয়েকমাসেই ১০ লবার ভিজিট হলো ইয়াহুর ওয়েবসাইট। এরপর আরোও বড় বিনিয়োগে চালু হলো ইয়াহুর সাইটগুলো। এরপর ব্যানার বিজ্ঞাপণ যুক্ত করার মাধ্যমে শুরু হলো ইয়াহুর আয়ের পথচলা। সার্চ ইনজিনের পাশাপাশি ইয়াহুতে চালু হলো ওয়েবসাইট ভিত্তিক বিভিন্ন সেবা। ব্যপক জনপ্রিয়তা পাওয়া ইয়াহু ধীরে ধীরে হয়ে উঠলো ইন্টারনেট বিশ্বের সম্রাট। এ বছরের ১লা মার্চ সাইটটি পা দিয়েছে ১৫ বছরে। দুই বন্ধু ডেভিড আর জেরির শখেরবশে তৈরি করা সার্চ ইনজিন আর ওয়েবসেবাগুলো এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইন্টারনেট বিশ্ব।
ছাত্রাবস্থায় অনেক স্বাপ্নিক ছিলেন বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। প্রতি ঘরে এমনকি প্রত্যেক মানুষের কাছে কম্পিউটার পৌছে দেয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। সেসময় কম্পিউটার বড় বড় গবেষনা কাজ ছাড়া অন্যেক্ষেত্রে ব্যবহারেরও চিন্তা করা হতনা। সেসময় প্রতিঘরে কম্পিউটার পৌছানোর স্বপ্ন দেখাটা নিতান্ত চাট্টিখানি কথা নয়! কিন্তু বিলগেটস সে স্বপ্ন দেখার সাহস পেয়েছিলেন কারণ তার সে স্বপ্নে সাহস জোগানোর মতও একজন কাছের মানুষ ছিল। আর সেই কাছের মানুষটি ছিল তাঁর বন্ধু পল অ্যালেন। বিল গেটস কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করার জন্য ১৯৭৫ সালে প্রথম কাজ শুরু করেন। কম্পিউটার সফটওয়্যার তৈরি করার জন্য কারিগরি দক্ষতা বলতে তেমন কিছুই তখন ছিলনা বিল গেটসের। বন্ধু পল অ্যালেনও এ ব্যাপারে তখন দক্ষ ছিলনা। তবু তারা হাল ছাড়েননি। দুই বন্ধু একে অপরকে সবসময় সাহস জুগিয়েছেন। আশাবাদী হয়েছেন। অ্যালেন আলতেয়ার ৮৮০০ মাইক্রোকম্পিউটারের প্রসেসর রুপান্তরের কাজ করছিলেন। আর বিল গেটস করছিলেন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ভাষা ‘বেসিক’ উন্নয়নের কাজ। সেসময় বিল গেটস ছিলেন হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কম্পিউটার সফটওয়্যার উন্নয়নের নেশায় ছেড়ে দিলেন হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা। একই বছর অ্যালেনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করলেন মাইক্রোসফট। শত বাধা বিপত্তি পার করে তারা বাজারে আনতে সমর্থ হলেন কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ। প্রথম উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমটি ছিল আইবিএমের সাথে যৌথভাবে তৈরি করা। এরপর তাঁরা একে একে বাজারে আনেন মাইক্রোসফট অফিস সহ বেশ কয়েকটি সাড়াজাগানো সফটওয়্যার। পল অ্যালেন আর বিল গেটসের তৈরি মাইক্রোসফট স্বীকৃত হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় কম্পিউটার সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসাবে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপি ৯০ শতাংশই কম্পিউটারেই ব্যবহৃত হয় পল আর বিল গেটসের উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম!
এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান গড়তে বন্ধুত্বের অবদান বলে শেষ করা যাবেনা। আরোও হাজারো উদাহরণ রয়েছে এরকম। উইকিপিডিয়া, ফেইসবুক সহ প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে বন্ধুদের অবদান। বন্ধুত্বের মাধ্যমেই তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন জয়, খুঁজে পেয়েছেন সাফল্য।
১. লেখাটি কিছুটা পরিবর্তিতভাবে দৈনিক কালের কন্ঠে প্রকাশিত। টেকটিউনসে বেশকিছু লিংক সহ নতুনভাবে প্রকাশ করলাম।
২. লেখার তথ্য সূত্রগুলো বেশিরভাগই উইকিপিডিয়া থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
৩. লেখায় লিংক ব্যবহারের ক্ষেত্রে উইকিপিয়া এবং সংশ্লিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের অফিসিয়াল লিংক এবং সরাসরি সেবার লিংক ব্যবহার করা হয়েছে।
৪. ছবিগুলো গুগলে সার্চ করে সংগ্রহ করা।
লেখাটি ভালো লাগলে মন্তব্য করবেন আশা করি।
আমি আল-আমিন কবির। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 14 বছর 10 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 15 টি টিউন ও 119 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
পেশা সাংবাদিকতা, কাজের ক্ষেত্র তথ্যপ্রযুক্তি। বর্তমানে দৈনিক কালের কন্ঠে কাজ করছি। ব্লগিংয়েও নিয়মিত।
ধন্যবাদ @ আল-আমিন কবির…ভালো হয়েছে।