একটা সময় ছিলো যখন মানুষ হাতঘড়ির সময় দেখে চলাফেরা করতো। তারপর যখন গত দশক থেকে মোবাইল ফোন জনপ্রিয় হলো, তখন মানুষ হাতঘড়ির বদলে মোবাইল ফোনের ঘড়ি দেখে চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেলো। কিন্তু অ্যাপেল সম্ভবত পরিকল্পনা করেছে মানুষকে আবার সেই হাত ঘড়ির সময়ে ফিরিয়ে নেবার। কিন্তু আরো আধুনিক, আরো বুদ্ধিদীপ্ত ও আরো আর্কষনীয়ভাবে।
তারই ফলশ্রুতিতে ভবিৎষত পৃথিবীর স্বাস্থ্যসচেতন মানুষদের জন্য পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি নিয়ে শেষ পর্যন্ত মাঠে নামলো টেক জায়ান্ট স্বয়ং অ্যাপেল! হাত ঘড়ির মতো অতীব পুরনো একটা প্রযুক্তিও যে ভবিৎষত দুনিয়ার প্রযুক্তি হতে পারে অ্যাপেল ওয়াচ না দেখলে সেটা ধারনা করাও বেশ কঠিন ছিলো।
উপস্খিত দর্শকরা নির্বাক বিস্ময়ে আইওয়াচের প্রেজেনটেশান দেখেছে এবং দেখা শেষ করে টুইটার আর ফেসবুকে ঝড় তুলেছে। সে সব দেখতে হলে এখানে ক্লিক করুনঃ] তাই ভাবছি iOS 8 বা iPhone 6/Plus নিয়ে তো অনেকেই জানেন, (যারা জানেন না তারা একটু গুগলে ঘাটঁলেই পাবেন) তাই আর ওসব নিয়ে প্যাচাল না পেড়ে বিশ্ববাসির জন্য একদম আনকোড়া নতুন প্রযুক্তি ’আইওয়াচের’ ব্যাপারে কিছু লেখা যাক।
কিছুক্ষন আগে অ্যাপেল প্রধান ‘টিম কুক’ উপস্থাপিত আইওয়াচের লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং দেখে বুঝতে পারলাম, এটা নিঃসন্দেহে একটা অসাধারন ও অভূতপূর্ব প্রযুক্তি হতে যাচ্ছে। পৃথিবীর মানুষ এমনটা এর আগে কখনো দেখেনি। আমরা মনে হয়, অ্যাপেল কর্তৃক প্রর্বতিত আইফোন ও App Store এর ধারনা গত ১ দশকে প্রযুক্তি বিশ্বকে যেমন আমুল বদলে দিয়েছে, তেমনি iWatchও বায়োমেট্রিক আর মানুষের স্বাস্থ্যগত ধারনার জগত আমুল বদলে দেবে।এক আইফোন দিয়ে যেমন গত প্রায় ১ দশক ধরে অ্যাপেল এক চেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে, আমার ধারনা iWatch হতে যাচ্ছে অ্যাপেলের সেইরকম আরেকটি পণ্য যেটা দিয়ে তারা আগামী অন্তত আরো ১ দশক চুটিয়ে ব্যবসা করে যাবে।এইরকম আরেকটা পরিধানযোগ্য পন্য এনেছিলো গুগল - তাদের চশমা ‘গুগল গ্লাস’। কিন্তু ওটা মনে হয় প্রায় ফ্লপ একটা প্রজেক্ট ছিলো। কারন বাজারে বা প্রযুক্তি দুনিয়ায় সেটা নিয়ে তেমন একটা মাতামাতি দেখিনি, বাজারেও ছাড়া হয়েছিলো খুবই সীমিত আকারে, যেন গুগলের আরেকটি পরীক্ষামূলক প্রজেক্ট।
বড় আকারে গুগল প্লাস কবে বাজারে আসবে, তা কেউ জানে না। সে হিসেবে অ্যাপেল ওয়াচ অনেক বেশী ম্যাচুউরড একটা পণ্য।
আইওয়াচ হাত ঘড়ির মতো ছোট্ট একটা ডিভাইস যেটা কবজিতে পড়তে হয় এবং আইফোন ৫ এবং ৬ এর সবগুলো মডেলের সাথে কমপাটিবল। মানে আইফোন ৫/৬ এর সাথে এটা ডেটা সিংক করবে, আইফোনে সংযোগ থাকা ওয়াইফাই এবং জিপিএস ব্যবহার করে ইউজারকে লোকেশন সংক্রান্ত লাইভ তথ্য দিবে। এতে বেশ কিছু অ্যাপ আগে থেকেই ইনসটল করা থাকবে এবং ব্যবহারকারী চাইলে আরো অ্যাপ নিতে পারবেন। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, এই ঘড়িটির নীচে অত্যন্ত শক্তিশালি ও অত্যাধুনিক ৪ টি সুদৃশ্য ইনফ্রারেড, দৃশ্যমান এলইডি আর ফটো সেন্সর রয়েছে যা দিয়ে মানব দেহের কারডিওভাসকুলার তথ্য (যেমনঃ পাসল রেট, ইত্যাদি) সঠিকভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষন করা সম্ভব।
আইওয়াচের ফিচার লিষ্ট আদতে মাইল খানেক লম্বা। সাধারন কিছু কাজ যেমন গান শোনা, কল করা, এসএমএস পাঠানো বা ছবি তোলা ছাড়াও অসাধারন কিছু কাজ করা যাবে যেমনঃ আইওয়াচ দিয়ে সকালে মর্নিং ওয়াক বা গাড়ী ড্রাইভ করতে করতে ফেসবুক বা টুইটারে স্ট্যাটাস দিতে পারবেন অথচ আপনাকে জগিং ট্র্যাক বা হাইওয়ে থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও দৃষ্টি সরাতে হবে না। আইওয়াচে থাকা ফেসবুকে অ্যাপ দিয়ে Siri এর সাহায্যে আপনি দৌড়াতে দৌড়াতেই স্ট্যাটাস আপডেট করতে পারবেন বা Siri কে দিয়ে মেইল চেক করা বা মিটিং মিনিট রেডি করাসহ অন্য যে কোন কাজ করাতে পারবেন। মানে যে অ্যাপগুলো ব্যবহার করতে আপনাকে এখন পকেট থেকে আইফোন বের করার কষ্টটুুক সহ্য করতে হয়, iWatch আপনার সেটুকু কষ্টও দূর করে দেবে। কবজি মুখের কাছে নিয়ে স্পেশাল এজেন্ট স্টাইলে Siri কে দিয়েই সব কাজ সারতে পারবেন, অথচ আপনার দু হাতের ১০ আংগুল থাকবে সম্পূর্ণ খালি!
সবচেয়ে বড় কথা হলো, আইওয়াচ মানুষের স্বাস্থ্যগত ব্যাপারে পরিসংখ্যান রাখতে বিশেষভাবে দক্ষ। যেমনঃ হার্টবিট এবং রক্তচাপ মাপা, ক্যালোরি বার্ণ হওয়া, এক্সারসাইজ টার্গেট মেইনটেন্ট করা, কত দ্রুত - কত ক্ষন ধরে - কত মাইল দৌড়ানো হয়েছে/হচ্ছে সে হিসাব রাখা ইত্যাদি। এমনকি আপনি ঘড়ির উপর দু আংগুল চেপে ধরে আপনার হার্টবিট ও ব্লাড প্রেশার অন্য অ্যাপল ওয়াচ ব্যবহারকারীির সাথে তো বটেই এমনকি সামাজিক সাইটগুলোতে শেয়ারও করতে পারবেন।
আগে তো মানুষ ক্যাশ টাকা পকেটে নিয়ে ঘুরতো, তারপর আসলো ক্রেডিট কার্ড এখন ক্রেডিট কার্ড পকেটে নিয়ে ঘোরার দিনও শেষ। পেমেন্ট করুন অ্যাপেল ওয়াচ দিয়ে!
তবে আমি যেটাতে সবচে বেশী অবাক হয়েছি, সেটা হচ্ছে, iWatch এর অভূতপূর্ব চার্জিং প্রযুক্তি। পৃথিবীর আর কোন ইলেকট্রিক পণ্য যে প্রযুক্তি কখনো ব্যবহার করেনি। সেটা হচ্ছে, wireless recharging technology বা ওয়্যারলেস ব্যাটারি রিচার্জিং প্রযুক্তি! চাজিং দ্রুততর করতে চাইলে ক্যাবলের ব্যবস্থাও আছে। আইওয়াচের নীচের ৪ টি সেন্সরের সাথে চৌম্বকীয় আংটা লাগিয়ে সেটা চার্জ দেযা যাবে। পুরো ব্যাপারটিই খুব অভিনব ও কৌতুহলদ্দীপক (নীচের চিত্রটি দেখুন)। অ্যাপেলের পরিকল্পনা রয়েছে যে, মোশন, সোলার ও ইনডাকশন পদ্ধতিও ওটাকে চার্জ করানো। মানে আপনি যখন দৌড়াবেন, তখন আপনার শরীর থেকে যে এনার্জি, হিট-টেম্পারেচার বা ক্যালোরি এমিট হবে, সেসব দিয়ে চার্জ করানো এবং/অথবা সোলার পাওয়ার দিয়ে চার্জ করা। তবে অ্যাপল ওয়াচের একটা বড় সীমাবদ্ধতা হলো, একবার পূর্ণ চার্জ দিলে এর ব্যাটারির স্থায়ীত্ব হবে মাত্র ২৪ ঘন্টা মানে আপনাকে প্রতি রাতেই ঘুমুতে যাবার আগে একে চার্জিংয়ে দিয়ে ঘুমাতে হবে।
ফিচার আর দক্ষতার কথা বাদই দিলাম, শুধু এটুকু বলি যে, আইওয়াচের যৌনাবেদনময়ী নকশা দেখে পৃথিবীর যে কোন প্রযুক্তি মনস্ক মানুষ প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাবে, যেমনটা আমি পড়েছি।
iWatch রিলিজ হবে আর কয়েক মাস পরেই; খুব সম্ভবত ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে। মূল্যঃ সাড়ে তিন শ ইউএস ডলার। সাথে থাকবে চামড়া, ধাতব অথবা প্লাস্টিকের বেল্ট। সমস্যা হলো, এটাকে কেউ আইফোনবিহীন ব্যবহার করতে পারবেন না, মানে এটা ব্যবহার করার সময় জামার পকেটে অবশ্যই আইফোন চালু থাকতে হবে। আপাততঃ আইওয়াচ Watch, Edition আর Sport - এই তিনটি সংস্করণে পাওয়া যাবে।
অ্যাপেল ওয়াচের আরেকটি দুর্দান্ত ফিচারের কথা না বল্লেই নয়। পুরনো ভায়াব্রেশন প্রযুক্তিকে অ্যাপল মুটামুটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অ্যাপল ওয়াচ আপনাকে ইনকামিং কল, ম্যাসেজ এবং অ্যালার্ট দিবে ভায়াব্রেশনের মাধ্যমে, মানে কল বা ম্যাসেজ আসলে আপনি আপনার হাতে কবজিতে হালকা কাপুনি অনুভব করবেন। ফলে আপনার ফোনের এলার্ট আপনি ছাড়া দুনিয়ার আর কেউ টেরও পাবে না। ধরুন আপনি মিটিংয়ে আছেন, বন্ধ ঘরে রিংটোন যেমন কানে বাজে, তেমনি ভাইব্রেশনের ঘড় ঘড় আওয়াজও পরিস্কার শুনতে পাওয়া যায়। মিটিংয়ের সময় তাই ভাইব্রেশন দিয়ে রাখলেও অনেককে বিব্রত হতে হয়। এ থেকে মুক্তি দেবে অ্যাপল ওয়াচ। সে আপনাকে এমন ভাইব্রেশন দেবে যে সেটা আপনি ছাড়া দুনিয়ার আর কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব না, এমনকি কেউ যদি আপনার কবজি ধরেও থাকে, তবু সেটা আপনি ছাড়া আর কেউ টের পাবে না। এমনকি, জিপিএস নেভিগেশনের সময় যে দিকে মোড় ঘুরতে হবে, অ্যাপল ওয়াচ আপনার হাতের সেদিকে ভায়াব্রেট সিমুলেশন পাঠাবে! পুরনো প্রযুক্তির অভিনব এ ব্যবহারের কথা শুনেই তো আমি মুগ্ধ!
অ্যাপল ওয়াচের আরো শ খানেক ছবি আছে এই লিংকেঃ
অ্যাপেল ওয়াচ নিয়ে খুব সম্ভবত এটাই বাংলাতে লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ রিভিউ!
আমি প্রলয় হাসান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 10 বছর 4 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 5 টি টিউন ও 93 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 4 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
অনলাইনে লেখালেখির শুরুটা ২০০৬ এর নভেম্বর থেকে। নিয়মিত লেখার শুরু আরো ১ বছর পরে। তারপর আর থেমে থাকিনি। একের পর এক লিখে গিয়েছি বাংলাদেশের স্বনামধম্য সব কয়টা বাংলা ব্লগ সাইটে, মিউজিক ফোরামে, ফ্লিকরে, ফেসবুক আর টুইটারে। এখনো লিখে চলেছি, আজীবনই লিখে চলার ইচ্ছে আছে। কারন লেখালেখি করে হয়তো পেট চালাতে...
ধন্যবাদ ভাই খুব সুন্দর টিউন এর জন্য।