আমাদের টেকজগতে ইয়াহু, সনি, মাইক্রোসফট, মটোরোলা, ওরাকল, গুগল, রেডহ্যাট ইত্যাদি নাম গুলো আমাদের কাছে খুব পরিচিত তাতে সন্দেহ নাই। আমরা প্রতিদিনই বিভিন্ন সেবা নিচ্ছি তাদের থেকে। তারা মূলত এই টেকজগত ও ইন্টারনেট বিজনেস ইন্ডাস্ট্রিতে সবার উপরে অবস্থান করছে। এখানে মজার বিষয় হল, আমরা প্রায় সবাই জানি তারা কারা এবং তারা আসলে কি করছে। কিন্তু আমরা অনেকেই তাদের ব্রান্ড নাম নির্বাচনের পেছনের ইতিহাস হয়তো জানি না। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে তাদের এই নাম নির্বাচনের পেছনে রয়েছে মজার সব ঘটনা। আজকের টিউনে আমি ইন্টারনেট ও টেকজগতে রাজত্ব করা ১৮টি বড় কোম্পানির নাম নির্বাচনের কিছু কারন তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
জোনাথন সুইপ তার গালিভার ট্রাভেলস বইয়েএ প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। আর yahoo! শব্দটির আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় নরপশু। শব্দটি প্রথম সেখান থেকে এসেছে। এই শব্দটি একজন ব্যক্তির চেহারা ও তার কর্মে বীভৎস/বিরক্তিকর রুপকে তুলে ধরে। আর ইয়াহু জনক Jerry Yang & David Filo তাদের পছন্দের ব্রান্ড নেম হিসেবে এই নামটি বেছে নেয়। David Filo-র কলেজ বান্ধবী টাকে প্রায় ইয়াহু নামে সম্বোধন করত। পরে জানা যায় তাদের স্ল্যাং ভাষার প্রতি ভালো লাগার কারণে তারা এটিকে তাদের ব্রান্ড নেম হিসেবে নির্বাচন করে।
একটি বহুজাতিক নথি ব্যবস্থাপনা কর্পোরেশন যার প্রথম নামটি ছিল Haloid Xerox. পরে তা পরিবর্তন করে রাখা হয় Xerox নামে। গ্রিক শব্দ Xerox নামটি এসেছে Xerography থেকে যার Xero মানে শুষ্ক আর graphy মানে লিখা। অর্থাৎ Xerography মানে হল শুষ্ক লেখা। কোম্পানির আবিষ্কারক Chestor Caelson এই নামটি নির্বাচন করেছিল কারন তিনি সেই সময় অনুলিপি তৈরির জন্য নোংরা ভারী তরল কালির পরিবর্তে একটি শুষ্ক দানাদার কালি ব্যবহার করতেন।
কম্পিউটার সিস্টেম ও সফটওয়্যার নির্মাতা কোম্পানি সান মাইক্রোসিস্টেমস আবিষ্কারক চারজন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র। এই কোম্পানি তৈরির আগে Bechtolsheim(চার বন্ধুর একজন) মূলত স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির নেটওয়ার্ক কমিউনিকেশন প্রকল্পের জন্য একটি সান ওয়ার্কস্টেশন ডিজাইন করেছিলেন। আর এই স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি নেটওয়ার্ক থেকেই Stanford University Network সংক্ষেপে SUN ব্রান্ড নেম হিসেবে নির্বাচন করে তারা।
সনি একটি জাপান ভিত্তিক কর্পোরেট গ্রুপ যা ইলেক্ট্রনিক্স থেকে শুরু করে গেম, বিনোদন এবং বিভিন্ন আর্থিক সেবা (যেমন বীমা ও ব্যাংকিং হিসাবে) খাতে নিজেকে নিজুক্ত রেখেছে। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা Akio Morita & Masaru Ibuka এই নামকরণ করেন ল্যাটিন শব্দ sonus যার অর্থ "শব্দ" এবং একটি স্ল্যাং ইংলিশ শব্দ sonny এর যৌথ শব্দের মাধ্যমে। তখন তারা নিজেদের বিবেচনা করত sonny boys হিসেবে যার অর্থ ছিল উজ্জ্বল বালক। কোম্পানিটির পূর্বের স্লোগান ছিল like.no.other আর বর্তমান স্লোগানটি হল make.believe
IBM এর সিস্টেম/অ্যাপ্লিকেশান/প্রোজেক্ট বিভাগে কর্মরত পাঁচ জন তরুন ইঞ্জিনিয়ার নিজেদের একটি কোম্পানি খোলার প্রতয়ে IBM ছেড়ে দেয়। পরে তারা সিস্টেম এনালাইসিস অ্যান্ড প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট নামে জার্মান সিভিল কোডের অধীনে একটি প্রাইভেট অংশীদারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এরও পরে নামটির পরিবর্তন করে রাখা হয় সিস্টেম অ্যাপ্লিকেশান অ্যান্ড প্রোডাক্টস ইন ডেটা প্রসেসিং (System, Application and Products in data processing) যার সংক্ষিপ্ত নাম হল SAP.
কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা Marc Ewing প্রথম কার্নেগী মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের সময় তার পিতামহের কাছ থেকে একটি লাল টুপি উপহার হিসেবে পান। পরে তিনি টুপিটি হারিয়ে ফেলেন এবং নিদারুণভাবে তা অনুসন্ধান করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। কিন্তু পরে তা আর পাওয়া যায় নি। এরপর তার কোম্পানি থেকে লিনাক্সের বিটা ভার্সন বের করেন এবং এটার নামকরণ করেন রেড হ্যাট লিনাক্স। এই রকম নামকরণ করে তিনি সকলের কাছে আবেদন করেছিলেন যেন তার লাল টুপিটি কেউ পেলে তা ফেরত দেয়। তাছাড়া তাদের কোম্পানির লোগোতেও রেড হ্যাটকে সিম্বল হিসেবে রাখেন।
ওরাকল নামটি প্রথম আসে সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্স এজেন্সি সংক্ষেপে CIA নামক এক প্রোজেক্ট এর মাধ্যমে। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা Larry Ellison ও তার সহপাঠী Bob Oats সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্স এজেন্সি তে যে প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করেছিলেন তার নাম ছিল ওরাকল। সেখান থেকে Larry তার কোম্পানির নামকরণ করেন ওরাকল। কোম্পানির অফিসিয়াল নাম ওরাকল হলেও কখনো কখনো এটিকে ওরাকল কর্পোরেশন হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠাতা Paul Galvin প্রথম মটোরলা রেডিও সুচনা করেন যা ছিল প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সফল গাড়ির জন্য রেডিও। Galvin ও বিনিয়োগকারী Bill Lear তাদের কোম্পানির ব্রান্ড নেম হিসেবে Victrola নাম নির্বাচন করে। পরে Galvin তার কোম্পানির সে নাম পরিবর্তন করে মটোরলা ব্রান্ড নেম হিসেবে নামকরণ করে।
Microsoft নামটি আসে MICROsoft SOFTware এই দুটি শব্দ থেকে। বিল গেটস এই দুটি শব্দ থেকে প্রথম micro-soft নামে তার কোম্পানির নামকরণ করে। এরপর micro-soft থেকে হাইফেন(-) চিহ্ন উঠায়ে দিয়ে শুধু microsoft নামে পরিবর্তন করে।
Mitch kapor "পদ্মাসন" শব্দ থেকে তার কোম্পানির জন্য নামটি নির্বাচন করে। তিনি ছিলেন সেই সময়কার অতীন্দ্রিয় মেডিটেশন বিদ্যার অধিকারী ছিলেন।
কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা Bob Noyce & Gordon Moore চেয়েছিলেন তাদের কোম্পানির নামকরণ হবে তাদের যৌথ নাম ব্যবহার করে মানে "Moore Noyce" নামে। কিন্তু চেইন হোটেল তাদের নামে আগেই এই নামটি ট্রেডমার্ক করে রাখে। তাই তারা INTegrated ELctronics এর সংক্ষিপ্ত নাম INTEL হিসেবে তাদের কোম্পানির নাম স্থাপন করেন।
কোম্পানির নামটি আসে একটি মজার ঘটনার মধ্যে দিয়ে। Bill Hewlett & Dave Packard তাদের কোম্পানির নাম নির্বাচনের জন্য একটি কয়েন টস পদ্ধতির ব্যবস্থা করেন। তারা এই টসে দুটি অপশন রাখেন। যে জিতবে তাদের দুইজনের নামের সমন্বয়ে নামকরণ হবে। মানে Bill জিতলে নামকরণ হবে Hawlett-Pickard নামে আর David জিতলে হবে Packard-Hawlett নামে। তাহলে ভাবুন তো তাদের টসে কে জয়ী হয়েছিল? 🙂
প্রতিষ্ঠাতা Jack Smith একটি কম্পিউটার থেকে ওয়েবের মাধ্যমে ইমেল অ্যাক্সেস করার ধারণা পেয়েছিলেন। যখন Sabeer Bhatia মেইল সার্ভিসের জন্য ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলেন, তখন তিনি (স্মিথ) এমন একটি পরিকল্পনা করছিলেন যেন সব ইউজারনেমের সাথে "মেইল" শব্দটি উল্লেখ থাকে। শেষ পর্যন্ত তিনি "Hotmail" নামটি নির্বাচন করেন যার সাথে "html" বর্ণ গুলো যুক্ত যা মার্কআপ ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে পরিচিত। প্রথম দিকে এটি HoTMaiL হিসেবে লিখা হত।
এটির নামকরন ছিল মূলত "Googol" যার সংখ্যা ১ থেকে শুরু এবং সাথে ছিল ১০০ টা শূন্য। এটি গুগলকে তার বিশাল পরিমান তথ্য প্রদান করার ক্ষমতা ফুটিয়ে তোলে। প্রতিষ্ঠাতা লাভের পর স্ট্যানফোর্ড স্নাতক ছাত্র সার্জি ব্রিন ও ল্যারি পেজ একটি দেবদূত বিনিয়োগকারীর কাছে তাদের প্রকল্প উপস্থাপন করেন। এরপর তাদের কোম্পানি নামকে পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। পরে তারা একটি চেক হাতে পায় এবং তা থেকে তাদের কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে Google রাখা হয়।
এই নামটি কোন নামের প্রথম অক্ষর থেকে উৎপত্তি হয় নি। এটি এসেছে San Francisco নামের সংক্ষিপ্ত রুপ থেকে। কোম্পানি তাদের লোগোতে তার সান ফ্রান্সিসকো নামের ঐতিহ্য প্রতিফলিত করে। এটি তার লোগোতে একটি নকশাকৃত গোল্ডেন গেট ব্রিজ কে তুলে ধরে।
অ্যাপল বা আপেল ছিল প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস এর প্রিয় ফল। এদিকে তার ব্যবসার জন্য ব্রান্ড নেম নির্বাচনের জন্য ভালো কোন নাম না পাওয়ায় প্রায় তিন মাস দেরি হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তিনি অন্য সহকর্মীদের দ্বারা সেই দিনের মধ্যে একটি ভাল নাম প্রস্তাব না করলে "অ্যাপল কম্পিউটার" নামেই তার কোম্পানী ডাকার করার নির্দেশ দেন। কিন্তু কারনবশত ভালো কোন নাম না পাওয়ায় স্টিভ জবস শেষমেশ অ্যাপল কে তাদের কোম্পানির নাম হিসেবে নির্বাচন করেন।
Apache ওয়েবসাইটে তাদের FAQ এর তথ্য অনুজানি জানা যায়, এই অ্যাপাচি নামটি আসে একজন নেটিভ আমেরিকান উপজাতি অ্যাপাচি এর নাম অনুসারে। কিন্তু এটি ভ্রান্ত ধারণা ছিল। এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা NCSA's httpd daemon এর কোড লিখার জন্য কিছু প্যাঁচ প্রয়োগ করে। এর ফলে সেখান থেকে "A PATCHy" সার্ভার তৈরি করেন এবং তার নাম অনুসারে তার কোম্পানির Apache নামকরণ করেন।
প্রতিষ্ঠাতা John Warnock তার প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করেন অ্যাডোব ক্রীক নদীর নামকরণে। এই নদীটি তার বাড়ির পেছন দিক দিয়ে এখনও বহমান।
ধন্যবাদ সবাইকে এত কষ্ট করে এই আর্টিকেলটি পড়ার জন্য। আমি লিখার আগেও এত চমৎকার তথ্য জানতাম না। আশা করি আপনাদেরও ভালো লাগবে। আর এটি পড়ে সবার মতামত পেলে আমার এত কষ্ট করে লেখাটা সার্থক হবে। ভালো থাকবেন সবাই।
আমি রনি সাটিয়ার। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 14 বছর যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 16 টি টিউন ও 573 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 3 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
Abode কোন কোম্পানি ভাই??