গ্রাম অঞ্চলে বা শহরতলীতে কোন বাচ্চার জন্ম হলেই এরা দলে দলে এসে ভিড় করে বলে ওঠে "দে নারে তোর মনিটারে একটু নাচাই" এই বলে নবজাতক কোলে করে নাচিয়ে বখশিষ নেয়, কিংবা শহরে মাঝে মাঝেই দেখা যায় এরা দলে দলে এসে বিভিন্ন দোকান থেকে চাঁদা তোলে। সমাজে ওরা খুব অবহেলিত, সভ্য মানুষরা ওদের বলে হিজড়া। আমি আমার এই টিউনে হিজড়া কাদের বলে, কেন হিজড়া হয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর ব্যাখা, এদের চিকিৎসার সাফল্যের রেকর্ড, ছাড়াও এদের সম্বন্ধে আরো কিছু তথ্য দিতে চেষ্টা করবো।
হিজড়া শব্দটি এসেছে আরবী হিজরত বা হিজরী শব্দ থেকে যার আভিধানিক অর্থ পরিবর্তন বা Migrate বা Transfer। এর ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশে বিশেষ এক ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধীদের হিজড়া বলে মূলত শারিরীক লিঙ্গের ত্রুটির কারনে এদের সৃষ্টি। এদের প্রধান সমস্যা গুলো হল এদের লিঙ্গে নারী বা পুরূষের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকে না। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় লিঙ্গ নির্ধারক অঙ্গ থাকে না। এসবের উপর নির্ভর করে তাদেরকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায।
শারীরিক ও মানসিক গঠনের উপর নির্ভর করে এদেরকে ৬ ভাগে ভাগ করা যায়। শারীরিক ভাবে পুরুষ কিন্তু মানষিক ভাবে নারী বৈশীষ্ট্য এর অধীকারী হিজড়াদের বলা হয় অকুয়া, অন্য হিজড়াদের ভরা হয় জেনানা, আর মানুষের হাতে সৃষ্ট বা ক্যাসট্রেড পুরুষদের বলা হয় চিন্নি।
এক্স এক্স প্যাটার্ন ডিম্বানুর সমন্বয়ে কন্যা শিশু আর এক্স ওয়াই প্যাটার্ন থেকে সৃষ্ট হয় ছেলে শিশু। ভ্রুনের পূর্ণতার স্তর গুলোতে ক্রোমোজোম প্যাটার্নের প্রভাবে ছেলে শিশুর মধ্যে অন্ডকোষ আর কন্যা শিশুর মধ্য ডিম্ব কোষ জন্ম নেয়। অন্ডকোষ থেকে নিসৃত হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এবং ডিম্ব কোষ থেকে নিসৃত হয় এস্ট্রোজেন। ভ্রুনের বিকাশকালে নিষিক্তকরন ও বিভাজনের ফলে বেশকিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সৃষ্টি হয় যেমন এক্স এক্স ওয়াই অথবা এক্স ওয়াই ওয়াই। এর ফলে বিভিন্ন গঠনের হিজড়া শিশুর জন্ম হয়।
মূলত এটি একটি শারীরিক গঠনজনিত সমস্যা যা অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের মতই কিন্তু প্রতিবন্ধকতার স্থানটি ভিন্ন হওয়াতেই তারা হিজড়া। হিজড়াদের শারীরিক গঠন মূলত ৩ প্রকার।
তবে ব্যাপারটি সমালোচিত হতে পারে তাই আমি আর এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখার সাহস করছি না।
ব্যাপারটি হয়তো অনেকেই জানেনা কিন্তু হিজড়া বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মানো কোন শিশুর যদি পরিনত বয়সে যাওয়ার আগে চিকিৎসা করা হয় তাহলে বেশীভাগ ক্ষেত্রেই তাকে সুস্থ করা সম্ভব। কিন্তু যখন আসলে বোঝা যায় সে সাধারন আর দশজনের থেকে আলাদা তখন আসলে অনেক দেরী হয়ে যায়।
পরিনত বয়সে যাওয়ার আগে যাদের চিকিৎসা করা হয় তাদের ক্ষেত্রে সাফল্যের সূচকটি স্পষ্ট করে না বলা গেলেও এটা বলা যায় এর পাল্লা বেশ ভারী। তবে পূর্ন বয়সে যাদের চিকিৎসা করা হয়েছে তাদের মধ্যে আমার জানামতে একটিই সাফল্যের রেকর্ড। সেটা ঘটেছিল ভারতের অমলার ক্ষেত্রে। সেটা একটু সবার সাথে শেয়ার করব।
অমলা ছিল ভারতের একজন। সে হিজড়া হলেও ছিল অপূর্ব সুন্দরী স্বাভাবিকভাবে তাকে কেউ বুঝতে পারত না এবং সে স্বাভাবিক ভাবেই চলাফেরা করতে পারত। এভাবেই একদিন সে গ্রামের একটি বিয়েতে যায় সেখানে তাকে দেখে গ্রমের এক যুবক যার নাম কার্তিক। সে তাকে পরবর্তীতে বিয়ে করতে চায় কিন্তু অমলা তার সমস্যার জন্য কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। তবে কার্তিকও নাছোড়বান্দা পিছু হটবার পাত্র সে নয়। শেষ পর্যন্ত আর কোন উপায় না দেখে অসলা এ ব্যাপারটি তাকে জানায়। সে জানার পরও তাকে বিয়ের ব্যাপারে পিছু হটে না তার যুক্তি শারীরিক এর চাইতে মনের ভালবাসা অনেক বড় তাই সে তাকে বিযে করবেই। এরপর অমলার পরিবারের সহযোগীতায় বিয়ে হয় কিন্তু কার্তিক সমাজ ও তারপরিবার থেকে বিতাড়িত হয়। তাদের বিযের পর বেশকিছুদিন গেলে কার্তিক একদিন পত্রিকা দেখে জানতে পারে এরকম একটি শিশু চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়েছে এটা জানতে পেরে সে অমলাকেও সেখানে নিযে যেতে চায়। অমলা যেতে না চাইলও কার্তিকের জোরাজুরিতে সে হার মানে। সেই ডাক্তার অমলাকে দেখে জানায় এই বয়সে এটা চিকিৎসার মাধ্যমে সফল হওয়া অসম্ভব। কিন্তু কার্তিক এর আবেগ এর কাছে হার মেনে ডাক্তার তার সমস্যাটি দেখে এবং দেখার পর ডাক্তার অমলার অপারেশনের উদ্দ্যেগ নেয়। অস্ত্রোপচার এর পর অমলা একজন সম্পূর্ণ নারীতে পরিনত হয় এবং পরবর্তীতে সে সন্তানের জন্মও দেয়। এ ব্যাপারে সেই ডাক্তারের অভিমত আসলে অমলার ব্যাপারটি তিনি কার্তিকের অনুরোধে দেখেন এবং দেখার পরই সে খেয়াল করে আসলে অমলার ত্রুটিটি খুবই সামান্য এবং তার মধ্য নারী বৈশিষ্ট্য প্রকট ভাবে বিদ্যমান তাই সে অস্ত্রোপচার করেন। তবে কার্তিক মনে করেন তার ভালবাসার্ জন্যই সৃষ্টিকর্তা তাকে পুরস্কৃত করেছেন।
আসলে যখন একজন মানুষ বুঝতে পারে সে হিজড়া তখন সে পরিবার, সমাজ সব জায়গায় অবহেলা আর অবজ্ঞার স্বীকার হয়। রংমহলে একটি লেখায় পড়েছিলাম একজন এরকম শার্টের নিচে মেয়েদের বিশেষ পোশাক পড়ে স্কুলে যাওয়ায় শিক্ষকরা তাকে প্রচন্ড মেরেছিল যে কারনে এরপর আর সে স্কুলে যায়নি। যখন একজন মানুষ এরকম অবহেলার স্বীকার হয় সব জায়গায় তখন সে তার দুঃখ শেয়ার করার জন্য তার মত যারা তাদের সাথে মিশে যায় এটাই স্বাভাবিক ব্যাখা। তবে এর বাইরেও বিভিন্ন কারন আছে।
কথিত আছে যখন কারো হিজড়ে বাচ্চা হয় তখন তা যদি হিজড়েরা জানতে পারে তবে তারা ওৎ পেতে থাকে তাকে নিজেদের দলে ভেড়ানোর জন্। একসময় ঠিকই তাকে হিজড়াদের দলে নিযে যায়। আরো একটা কথা প্রচলিত আছে যদি না নিতে পারে তাহলে তারা দলবদ্ধভাবে এসে হাতেতালি বাজাতে থাকে যা তারা সবসময়ই বাজায় আর এ হাতেতালিতে নাকি কি এক অমোঘ আকর্ষন আছে যা শুনে অন্য হিজড়ারা আর ঠিক থাকতে পারেনা সেও এসে তাদের এই হাতেতালিতে যোগ দেয় যদিও এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নাই। এছাড়াও ভারতের কিছু কিছু জায়গায় আরো কয়েকদশক আগে খোঁজা পুরুষ বানিয়ে দল ভারী করত।
একসময় (আরো কযেক দশক আগে) ভারতের কিছু ক্লিনিক ছিল যারা টাকার বিনিমযে পুরুষদের খোঁজা পুরুষ বা ক্যাসট্রেড হিজড়ায় পরিনত করত। একশ্রেণীর দরিদ্র পুরূষরা এটা করত বেঁচে থাকার তাগিদে আয রোজগারের আশায়। আর তারা ছাড়াও অনেক হিজড়া দল ছিল (মূলত ভারতে) যারা শিশু অপহরন করত তারপর তাকে ১০ দিন নির্জন স্থানে আটক রেকে ১১ তম দিনে লাল শারী পরিয়ে ক্যাসট্রেশন করে হিজড়াদের দলে ভেড়াত।
হিজড়াদের জন্য যৌন কাজ আইনত শ্বাস্তিযোগ্য অপরাধ কিন্তু মানুষ হিসেবে তাদেরও তো আছে এসব তো অনুভূতি। যেখানে পশুরও আছে এই অধিকার সেখানে মানুষ হয়ে কেন এটা শ্বাস্তি যোগ্য অপরাধ তা যারা এই আইন করেছে তারাই ভালো জানেন। তবে হিজড়াদেরও বিয়ে হয় সেটা হয় একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায়। এ অঞ্চলের (দক্ষিণ এশিয়া) হিজড়ারা বেশীর ভাগ মুসলিম হলেও তারা হিন্দুদের এই পুজাটি করে যার মাধ্যমে তারা ভগবানের সাথে নিজের বিযে দেয় এরপর সারাদিন তারা সংসার সংসার খেলে। সন্ধ্যা এলে তারা বিধবা হয় সাদা শারী পড়ে। পুরো বিধবাবেশ ভূষা গ্রহন করে স্বামীর মৃত্যু শোক করে। অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। তাদের সে কান্নায় আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়। কিন্তু তাদের কান্না কি বিধবা হওয়ার জন্য? আমরা সবাই বুঝতে পারি তাদের এরকম অঝোর ধারায় জল ঝড়ার কারন।
মূলত তারা তাদের এলাকার বিভিন্ন দোকান পাট আর বাজারে গিয়ে টাকা তোলে এই অর্থকে তারা তোলা বলে এছাড়াও কোন নবজাতকের জন্ম হলে সেখানে গিয়ে নাচ-গান করে চাঁদা তোলে তারা। তারা তাদের জমাকৃত সকল টাকা তাদের গুরুর কাছে দিয়ে দেয় এরপর গুরু যা দেয় তা থেকে প্রসাধনী কেনে আর ব্যাংকে জমা রাখে। তাদের খাবারের বন্দোবস্ত তাদের গুরুই করে।
হিজড়ারা মূলত তাদের আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন তাকে। তাদের বাবা-মা এর সাথে তাদের সম্পর্ক থাকে না। তাদের প্রত্যকের দলে থাকা গুরুকেই তারা তাদের অভিভাবক মানে সেই তাদের সব। তারা যখন দলে যোগ দেয় তখন গুরু তাদের আগের পোশাক থেকে শাড়ি পড়িয়ে দেয় এবং তাদের কপালে আশীর্বাদ স্বরুপ আচঁল ছুয়ে দেয় আর মন্ত্র পড়ে ফুক দেয় এটাকে তারা বরে রাখি বন্ধন। এরপর তারা তার অধীনেই চলে সে যা বলে তা করে নিজেদের টাকা তার কাছে দিয়ে দেয়।
সারা বিশ্বেই হিজড়ারা একটি কমিউনিটি মেইনটেইন করে এবং নকণ কমিউনিটি এর মধ্য তারা আবার যোগাযোগ রক্ষা করে। ঢাকাতেও তার বিকল্প নয়। ঢাকাতে হিজড়ারা মূলত পাঁচটি দলে বিভক্ত এক দলের হিজড়ারা অন্য দলের এলাকায় গিযে তোলা তুলতে পারবে না। তাদের এই পাঁচটি দলের প্রত্যেকটিতে আছে একজন করে গুরু। এসব এলাকা আর তাদের গুরু হচ্ছে।
আগেই বলেছি হিজড়ারা অনেকেই মুসলিম হলেও তারা অনেক হিন্দু রীতি নীতিতে বিশ্বাষ করে। তাই তাদের যদিও কবর দেয়া হয় কিন্তু তারা মনে করে তাদের আবার পূণঃজনম হবে। প্রত্যেক হিজড়াকে কবর দেয়া হয় তারা যে বিছানায় থাকে তার নিচে এটাই তাদের রীতি (তবে বর্তমানে স্থান সংকুলানের জন্য তাদের অন্যত্রও কবর দেয়া হয়)। কিন্তু তাদের কবর দেয়ার নিয়মটি খুব অদ্ভুত তাদের কবরে প্রথমে ঢালা হয় লবন তারপর লাশ তারপর দেয়া হয় ফুল তারপর আবার লবন। এটার মূল কারন হল তাদের বিশ্বাষ এভাবে কবর দিলে তাদের আগের সকল পাপ ধুয়ে পরবর্তী জনমে তারা পূর্ণ নারী বা পুরূষ হিসেবে জন্ম গ্রহন করতে পারবে।
আমাদের দেশে তারা কখনোই একজন মানুষের মর্যাদাতো দূরে থাক কুকুর বিড়ালের অধিকার পায় না। কিন্তু হিজড়াদের সামাজিক অধিকার প্রাপ্য কিনা সেটা সবার উপর ছেড়ে দিলাম। তবে একটা কথা বলি আমাদের দেশে হিজড়াদের ভোটার হওয়ার নিয়ম না থাকলেও ভারতে কিন্তু লোকসভার সদস্য হয়েছিলেন হিজড়া শবনম মৌসি।
সুত্রঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট, উইকিপিডিয়া, ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের ওযেবসাইট, বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন চিকৎসক, মুম্বাই পুলিশের ওয়েবসাইট, স্টার নিউজ, ড. আজমল ও আসমতের লেখা প্রাণীবিদ্যার কিছু বই, মাসিক দেশ (কলকাতা) এর ১৯৮৬ সালের একটি সংখ্যা, মাসিক সানন্দা (কলকাতা) এর ১৯৯৭ এর একটি সংখ্যা, সাপ্তাহিক ২০০০ এর ২০০৮ সালের একটি সংখ্যা, দৈনিক প্রথম-আলো, দৈনিক ইনকিলাব এবং ঢাকার বেশ কয়েকজন হিজড়া।
টিউনটি পূর্বে প্রকাশিতঃ টিউটোরিয়ালবিডি.কম
আমি প্রযুক্তি প্রেমী। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 15 বছর 10 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 136 টি টিউন ও 2157 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 3 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
গুড জব শাকিল ভাই ………………… 🙂